জীবনের কল্যাণই সাহিত্যের মৌলিক অনুষঙ্গ

প্রচ্ছদ » সাহিত্য ও সংস্কৃতি » জীবনের কল্যাণই সাহিত্যের মৌলিক অনুষঙ্গ
শুক্রবার, ২১ জুলাই ২০২৩



---

।। মতিন বৈরাগী ।।

সাহিত্যে কবিতার ইতিহাস সবচেয়ে প্রাচীন। প্রতিটি কালের সাহিত্য সেই কালের চিন্তাচেতনাকে ধারণ করে। সৃষ্টিশীল কাজ থেকে আমরা যত সুন্দর করে একটি সময়ের চিত্র পাই তা ইতিহাস বা অর্থশাস্ত্রেও মেলে না। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা যা কিছু সৃষ্টি করেন তা তার সময়কালের তার দেখা; তার শেখা, তার অনুধাবন ও অনুভব থেকে রূপান্তর। যেহেতু চিন্তার অভ্যেসটা গড়ে ওঠে সমাজে চলমান জীবনধারার অনুগামী হয়ে এবং যেহেতু সমাজের রূপান্তর একমাত্র আদর্শগত বিপ্লব দ্বারা সংগঠিত না হলে চিন্তার মূলসূত্রগুলোর পরিবর্তন সমাজ-রাষ্ট্র পরিবর্তনের ধারাকেই অনুসরণ করে এবং শ্লথগতির পরিবর্তনগুলোর অনুষঙ্গগুলো অনুধাবনযোগ্য না হয়ে সৃজনশীলদের মানসে পুরনো চিন্তার অনুষঙ্গগুলো ঝিলিক দিতে থাকে। কারণ সমাজ বদলের কারণগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিপ্রসারতা এবং বিশ^-মোড়লদের কারসাজিমূলক দুরভিসন্ধির, তারা যা কিছু করে সবই পুঁজির স্বার্থকে সমুন্নত রেখে ভোগ লালসা এবং লুটপাটের উদ্দেশ্যে করে। তাই সমাজ বদলায় নোংরার ওপর পরিষ্কার চাদর দিয়ে নোংরাকে দৃষ্টির অগোচরে রাখার মতো করে। এইসব উদ্দেশ্যের কারণেই মানুষ ভাবে আগেই ভালোছিলাম, কোনো উন্নয়ন তাদের অভ্যেস রুচিকে বদলে আধুনিক চিন্তাচেতনার মানদ-ে উন্নীত করতে পারে না। কবি শিল্পী সাহিত্যকরা স্ব স্ব সমাজেরই মানুষ, স্ব স্ব সমাজের জীবনাচরণদ্বারা তারাও একইভাবে অনুরক্ত এবং চিন্তারগ-িকে ভাঙতে সমাজে যে শিক্ষার বিপুল প্রয়োজন দরকার তা শাসকরা তাদের স্বার্থেই তাকে অনুপস্থিত রেখে কেবলমাত্র ভণিতাদ্বারা লুটপাট করে জনতাকে। তবে ইমারতগুলো প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করার ভাগ্যলিপি তৈরি করে দেয়।

‘বাংলা আধুনিক সাহিত্যের চরিত্র মূলত ইংরেজ শাসকদের ঔপনিবেশিক শাসনের আশু প্রয়োজনে প্রবর্তিত ও পরিচালিত ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যক্ষ ফসল হিসেবেই সূত্রপাত হয়েছিল উনবিংশ শতকে। ইংরেজদের কাছে আমরা পরাজিত না হলে সংস্কৃত সাহিত্য ভারতচন্দ্র, কৃত্তিবাস, কাশীরাম, রামপ্রসাদ, মুকুন্দরাজ, বৈষ্ণবপদাবলি ও লোকসাহিত্যের ধারা বহন করে আধুনিকতায় যুক্ত হতে আরো পিছিয়ে থাকত এবং পুঁথিসাহিত্যেই হয়তো ঘুরপাক খেত। এমন মত প্রকাশ করেছেন প্রতাপ নারায়ণ বিশ^াস তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিশ^সাহিত্যের’ ভূমিকায়। যদিও এই মন্তব্য পুরোপুরি যথার্থ বলে মেনে নেয়া কঠিন, কারণ সভ্যতার গতি উপনেবিশক শক্তি এগিয়ে দেয় না। সমাজের অভ্যন্তরে চলমান ক্রিয়াই সমাজ-রাষ্ট্র পরিবর্তনের চিন্তায় অনুষঙ্গ হয়। যদিও তার গতি শ্লথ আর তার গতি পাবার নির্ভরতা প্রগতিশীল রাজনৈতিক উপস্থিতির ধারায়। বিশ^সভ্যতা বিকাশ লাভে আরো নানা অনুষঙ্গের ক্রিয়া রয়েছে আর তার পথ ধরে পরিবর্তন ঘটে স্থানিক সভ্যতা ও চলমান চিন্তায়। তেমনি সভ্যতাও কাঠামোগতভাবে মনোজগতে বিস্তৃত যা নানা শিল্প-সাহিত্যের বিষয় রূপায়নে উপস্থিত ঘটে।

কবিতার পাঠক আমাদের সমাজেই শুধু নয় তথাকথিত উন্নত সমাজেও কমবেশি একই রকম। আজকের সময়ে পাঠক যেটুকু তৈরি হয়েছে তা বর্তমানের, যদিও অতীত এখনো ঝেড়ে মুছে যায়নি। মানুষ মনোগতভাবে পূর্ব সমাজের বহুকিছু বহুকাল ধারণ করে এবং এখনো অনেকে আধুনিক সাহিত্যের চাইতে অতীতের সৃষ্টিগুলোতে অশ্রু ফেলে। পুঁথি নেই, তবু জনপদের মানুষ তার সুরটান উঠলে কান খাঁড়া করে। একদিন আরো সামনে এসব চেতনা জগত থেকে মুছে নিশ্চেতনায় স্থান নেবে। [তবে এও সত্য যে একসাথে সব কিছুর পরিবর্তন ঘটে না।] আমাদের কাব্য যেমন এখনো ৩০/৪০/৫০ এর সুর ধারণ করে বিবৃত হচ্ছে, তেমনি আবার তার গতিমুখ নানাভাবে নানা দিকে প্রসারিতও হচ্ছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার সৃষ্টিতে বিপুল বিস্ময় যুক্ত করতে পেরেছিলেন সে তার অসম্ভব মেধা ও বিশ^সাহিত্য আত্মস্থ করার ফসল। তার গীতকাব্য অধিকাংশ মন্ত্র সাহিত্য; আধুনিক যুগের ঋষির দৃষ্ট নব-মন্ত্র-সংহিতা’ [রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা, দেবী প্রসাদ বন্দোপ্যাধায়] সে কারণে তার সৃষ্টির ভেতর আধুনিকতার উত্তরণ ঘটেছে ইথিকসকে সামনে রেখে আর এইযুগ আর একজন রবীন্দ্রনাথ তৈরিও করতে পারে না, যেমন পারে না মহাকাব্য সৃষ্টির উপাদান জোগাতে। একালে আর কালিদাস, একিলিস আসবে না কারণ তার চাহিদা নেই। তাই সাহিত্যকর্মও সমাজচাহিদার ওপর নির্ভরশীল। আজকের সমাজ ভেতরে বাইরে ভাঙছে, ভাঙনের মুখের এই সমাজে কবি শিল্পীর অন্তরদর্শনও ভাঙাগড়ায় পড়েছে। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সাথে নির্মাণ কলায় এসেছে নতুনত্ব কিন্তু তা ন্যূনতম পর্যায়ের। তবে স্মরণে নিতে হবে যে কবি বা শিল্পীর সৃষ্টি কেবল তার মন-আবেগের আহøাদ নয়, তার দায় রয়েছে। এই দায় সমাজ রাষ্ট্র এবং মানুষের প্রতি। যে সৃষ্টি জনগণকে হেয় করে, কুসংস্কারে নিমজ্জিত করে, চেতনাকে শাণিত না করে নির্জীব করে মানুষকে উচ্চবিত্তের অধীন হতে শিখায়, তাতে যতই শিল্পানন্দ থাকুক তা অহেতুক এবং জঞ্জাল। অন্য দিকে খেয়াল রাখতে হয় জনচেতনার স্তরিক আকার আকৃতির প্রতি। যদি সৃষ্টি জটিল আবর্ত ধারণকারী হয় এবং সমাজচেতনা স্তর থেকে দূরগামী হয় তাহলে মানুষ তা বুঝতে না পারলে তাকে গ্রহণও করে না। শিল্প-সাহিত্য-কাব্য সব সময়ই মানুষকে নিয়ে। তার আশা জীবন-যাপন ভাবনা-চিন্তার নব রূপায়ন। শিল্প-সাহিত্য কেবল উপভোগের বিষয় নয় বরং উপলব্ধির বিষয়। ‘মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/ আমি সেই দিন হব শান্ত, /যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না’- এর শিল্পগুণ নিশ্চয়ই আবেগ মথিত এবং সবাইকে আমোদিত করে, একই সাথে মানুষ গ্রহণও করে উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে।

প্রত্যেক দশকের কবিদের সামনে রয়েছে পূর্বজদের অভিজ্ঞতার ভা-ার। এখন দেখার বিষয় হলো তারা কতটুকু সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ওই নির্মাণকে নবরূপে রূপায়নে সক্ষম। ‘আসলে প্রতি যুগের কবিরা ঐতিহ্যের সাথে মিলিয়ে ছোটো-ঠোঁটে যেসব বদল করেন, তাতেই কবিতা নতুন হয়ে ওঠে। তারা মামুলি নিয়মেই লেখেন, কিন্তু সেই মামুলিকেই এমন করে ব্যবহার করেন যা পুরনো কবিরা করেননি। এটাই হলো ঐতিহ্যের নবায়ন। এসব ছোট ছোট সংকোচন, সম্প্রসারণ, সংকলন, বিকলন, পরিশীলন-এ আধুনিক কালের বিভিন্ন যুগযন্ত্রণা ধরা পড়ে [বুদ্ধদেব বসু, স্বদেশ সংস্কৃতি]’ বাস্তবে তেমন খানিকটা ঘটলেও মূল পরিবর্তনটা আসে সমাজ-বিবর্তনিক ধারায়, যার সাথে যুক্ত হয় মানুষের সাথে মানুষ। সত্য এই যে তারপরও এর গতি তীর তীব্র বেগা নয়, বরং সবকিছু ভাঙছে আর শ্লথও হচ্ছে এই নিয়মে। আমাদের প্রথম শতকের কবিদের মধ্যে আমরা সেই প্রবণতাগুলো লক্ষ করতে পারি। তবুও এ কথাটি অস্বীকার করা যায় না যে সকল নতুনের মধ্যে রয়েছে পুরনোর অভিজ্ঞতা। কবিতা মূলত এমন একটা শিল্পমাধ্যম-রূপের, যাকে স্থাপন থেকে পুনরস্থাপনকালে বিষয়ের মূল গলে গেলেও তার নির্যাস থেকে প্রস্তুত হয় এক রসায়ন- বিষয়ের গোপন গুণাগুণ সরল কিংবা জটিল আকারের হলেও- থাকতে হয়। কারণ জগত উদ্দেশ্যহীন নয়; কোনো কিছু কেবল অলীক ভাবনারও নয়, যা কিছু মনে হয় উদ্দেশ্যহীন তারও একটা উদ্দেশ্য থাকেই। আসলে যত রকম মত ও মতের সমাহার তা মানুষের, আর এ কারণে এক কবি থেকে আরেক কবির দূরত্ব কাছেরও নয়, দূরেরও নয়। তাই দেখি কবি আমিনুল ইসলাম যা বলেন তা বলেছেন অন্য কেউ তারও আগে, বা বলবেন আরো কেউ তার পরেও। কারণ জগতে যে বস্তুসমূহ আছে, তার বিবর্তন আছে রূপান্তর আছে, কিন্তু নতুন কিছু নেই। তাই আছের সংসারে এত কিছুর পরও অভাবের অভাবও আছে। আমিনুল ইসলাম। তিনি কবিতাকে করেছেন প্রয়োজনীয় হাতিয়ার চিনিয়ে দিতে যে পানি কেবল পানি না, তার রূপান্তরে অকসিজেন ও হাইড্রোজেন, সে বা®প হয়, সে জমাট বাঁধে, বরফ কুচি হয়, সে হাওয়ায় ভাসে, সে শীতল করে ধরিত্রিমাতার খরদাহতাপ। তেমনি সমাজ রাষ্ট্র মানুষের, একান্ত দর্শন জীবনও তার। মানুষ আকস্মিক নয়, দীর্ঘপথ পরিক্রমায় সে বহন করছে তার স্মৃতি, শ্রুতি তার অনুভূতি ও অনুভবের বিস্তার। এ যেন মাটির স্তরের মতো, প্রত্যেকটি স্তর যেমন আলাদা সময় ও কালের কথা বলে। জানতে পারি মানুষের অতীত ইতিহাস এবং দেহমন ও রূপান্তর। তেমনি সৃষ্টি থেকেই আমরা আলাদা করতে পারি কবির সময় ও কালকে। অবস্থার ফেরে অনেক কিছুর বদল যেমন স্তরগুলো বাতলায় তেমনি মানুষ যে ভাবনা, রুচি, অভ্যেস এবং বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কৃৎকৌশল কবির বা শিল্পীর মনধারায় বহন করে এগিয়ে চলে। নৃবিজ্ঞানের ধারণায় উভচর জীবনের অনেক লুপ্ত চিহ্ন মানুষের দেহকা-ে বর্তমান রয়েছে। তেমনি আজিকার চলার গতিতে তার উপস্থিতি থাকলেও তা অনুধাবন ক্রিয়ায় দৃষ্টিগ্রাহ্যও হয় না। তাই বলে তা নেই, তাতো নয়- হয়তো আছে, তেমনি আমিনুল ইসলামের কবিতায় আমরা সেই চিহ্নগুলো শনাক্ত করতে পারি, তার কবিতায় যেসব ঠুনকো বিষয়কে বিষয়ের গৌরবে উচ্চকিত করেছে তা সবই মানুষের।

‘অথচ তোমার জন্য বসে থাকি অজুহাতের স্টেশনে-/ইচ্ছাকৃত ফেল করে আহ্নিকগতির ট্রেন!/তুমি আসতে চেয়েছো অথবা চাও-এর বেশি/কোনো কিছুই তো ঘটেনি; তোমার আসতে চাওয়াটা/কেন এত ব্যঞ্জনা রচে আমার এলোমেলো ভাবনায়-/আমি সেও বুঝি না! তুমি যদি বা আসোই-/ সে ও তো নিজ কক্ষপথে ফিরে যাওয়ার জন্যই আসবে-/এতটুকুও রয়ে যাবে না- রেখে যাওয়ার মতো/কিছুই আনবে না সাথে,- /তোমার জন্য কেন এই অদ্ভুত অপেক্ষা?/(মহাবিশ্ব/ আমার ভালোবাসা তোমার সেভিংস অ্যাকউন্ট) কবিতায় নানা ভাব, নানা ব্যঞ্জনায় ভাষ্য হয়ে রূপবান হতে পারে প্রকাশে। কিন্তু তার সবটুকু উদ্দেশ্য মানুষ এবং মানুষকে নতুন চিন্তায় যুক্ত করা মূলত সৃষ্টির প্রথম কাজ, সেখানেই তার সার্থকতা।

বাংলাদেশ সময়: ১৯:০৯:২২   ২০৯ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য ও সংস্কৃতি’র আরও খবর


ভোলায় দিনব্যাপী ঈদ আনন্দমেলা
দিলরূবা জ্যাসমিনের উপন্যাস “তবুও ছুঁয়ে যায়”- এর মোড়ক উন্মোচন
আজকের ভোলা প্রতিনিধি কবি নুরুল আমিনের কাব্যগ্রন্থ ‘ধান শালিকের কাব্যমালা’ প্রকাশ
দৌলতখানের কৃতি সন্তান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কবি হায়াত মাহমুদ অসুস্থ ॥ সকলের দোয়া প্রার্থী
ভোলায় বর্নাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হল গণজাগরনের সাংস্কৃতিক উৎসব
ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের সাহিত্য
কারার ঐ লৌহকপাট
উপমা না বুঝলে সাহিত্য বোঝা দায়
ভোলার দুই দিনব্যাপী সাহিত্য মেলার শুরু
উপন্যাস : রীতি ও প্রকৃতি



আর্কাইভ