: গাজী গিয়াস উদ্দিন :
দেশে দেশে মুক্তিসংগ্রামে ও জাগরণে সাহিত্য এক বিপ্লবী শক্তি, বাংলা সাহিত্যে রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়/দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়’। সাহিত্যের এ শক্তি মারণাস্ত্রের চেয়ে বড়। নজরুল সাহিত্যকে সামরিক শক্তির সাথে তুলনা করা হয়।
‘এদেশ ছাড়বি কিনা বল/ তা নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল’। অথবা ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান/আসি অলক্ষ্যে উড়ায়েছে তারা দিবে কোন বলিদান’।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির এ অসীম শক্তি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও বিজয় অর্জনে সহায়ক শক্তি জুগিয়েছে। তেমনি ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানবতার মুক্তি সংগ্রামে তাদের কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যে অবদান চিরস্মরণীয় এবং গণজাগরণে কার্যকর অবদান রাখছে।
শুধু তাই নয়। ফিলিস্তিনি মহিলা কবি-কথাশিল্পী হিবা আবু নাদা গত ২১ অক্টোবর ২০২৩ ইসরাইলের বিমান হামলায় নিহত হন। স্বাধীনতাকামী জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক, কবি, শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকারকর্মী হিবা ২০১৭ সালে তার উপন্যাস ‘অক্সিজেন ইজ নট ফর দ্য বেড’ এর জন্য শারজাহ পুরস্কার লাভ করেন। স্বদেশের জন্য তরুণী কবি হিবার জীবন দান এবং কবিতা যেন একইসূত্রে গাঁথা। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে এ জাগরণের কবি লিখেন :
জান্নাতের ভেতরে আমাদের এক নতুন গাজা হবে।
আমাদের সেই নতুন শহরে থাকবে না কোন
অবরোধ।
মৃত্যুর আগের দিন ২০ অক্টোবর তিনি লিখেন অশ্রুভেজা কবিতা :
‘মহান প্রভু আল্লাহ আর শহীদদের মাঝখানে/ এই গাজা নগরীতে আমরা আজ দাঁড়িয়ে আছি/ (এই গাজায়) মুক্তি আন্দোলনের সাক্ষী আমরা/কোথায় থাকব আমরা? আজ সেই অপেক্ষায়/ হে আল্লাহ! আমরা সবাই তোমার সত্য/ প্রতিশ্রুতির প্রতীক্ষায় আছি’।
১৯ অক্টোবর লিখেন:
‘আমার বন্ধু তালিকা ছোট হয়ে আসছে ক্রমেই/ছোট্ট ছোট্ট কফিনে সঙ্কুচিত হচ্ছে একেকটি মুখ/ মিসাইলের আঘাতে উড়ে যাওয়া বন্ধুদের/ আমরা না পারছি ছুঁইতে।’
উল্লেখ্য, প্রাচীন ভাষা আরবির ঐতিহ্যগত সৌন্দর্যের স্বাদ মূল ভাষায় কতটা প্রাঞ্জল ও শব্দ-উপমা শিল্পগুণে সমৃদ্ধ- তা অনুবাদ থেকেই অনুমেয়।
ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের কবি ফাদওয়া তুক্বান তার ‘অস্তিত্ব’ কবিতায় লিখেন:
‘আমাদের মাঝে বিশাল দূরত্ব সত্ত্বেও/ অস্তিত্ব আমাদের একত্রিত করেছে-অস্তিত্ব’।
এখানে তিনি প্রেমিকার ভালোবাসার বন্ধনের অস্তিত্ব দিয়ে মাতৃভূমি ফিলিস্তিন ভূখ-ের অস্তিত্বের উপমা দিয়েছেন। ফিলিস্তিনি কবি হুসাম আল সাবে একজন সঙ্গীতশিল্পী ও গীতিকার। ‘আমার বন্দি সন্তান’ কবিতায় তিনি শত শত প্রেম ব্যর্থ জীবনের চিত্র এঁকেছেন এভাবে।
‘আমার কাছে বসন্ত ঋতুর চেয়ে বেশি মূল্যবান নয়
কিন্তু তারা বসন্তকে আসতে দেয়নি
তারা বসন্তকে আটকে রেখেছে, বসন্ত হারিয়ে গেছে
দখলদার বাহিনী আমাদের যা কিছু সুন্দর
সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে, ধ্বংস করেছে
তারা আমাদের মৌমাছির কাছ থেকে মধু চুরি করেছে
আমাদের জমিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে
তারা সদ্য ফোটা ফুলকে উপড়ে ফেলেছে।
পরাধীনতার নি®েপষণে অতৃপ্ত আত্মার প্রতিধ্বনি কবি মোহাম্মদ দিব সুলাইমানের ‘হৃদয় জড়িয়ে ধরো’ কবিতায় :
ওহ ফিলিস্তিন! আমার প্রথম প্রেম
আমার আকাংখা সমুদ্রের মতো প্রশস্ত
আমার হৃদয় প্রতি ভোরে-
জন্ম শিকড়ের জন্য গেয়ে ওঠে !
মার্কিন প্রবাসী ফিলিস্তিনি কবি, নাট্যকার গবেষক ও স¤পাদক নাথালি হান্দাল তাঁর এক লেখায় ইহুদিদের ধর্মীয় কুসংস্কার কিভাবে বর্বরতায় রূপ নিয়েছে। সে বিষয়ে লিখেন : ইহুদিরা মনে করে ‘খোদা তাকে ফিলিস্তিনে পাঠিয়েছেন স্বর্গীয় উপাধি এবং পূর্ণ অধিকার দিয়ে, যেন সে ওই ভূমির অ-ইহুদিদের বিতাড়িত করে। (তারা মনে করে) ইসরাইল স্বয়ং খোদার দেয়া অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন’।
তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, ‘আমাদেরকে আমাদের স্বাধীনতার জন্য তদবির করতে বলছে ওইসব লোকদের কাছে যারা, আমাদের হয় তালাবদ্ধ করেছে, না হয় লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে’।
বস্তুত গাজায় বসবাসরত মানুষের অবস্থা ঠিক ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো অথবা পুরো গাজাই যেন একটা বিশাল জেলখানা। নির্যাতিত গাজার চিত্র ফুটে উঠেছে যেসব বইতে : ‘মাইনর ডিটেইল’ আদানিয়া সিবিলের উপন্যাস। ১৯৪৮ সালে নাকবার যুদ্ধে ফিলিস্তিনের বিশাল অংশ বিধ্বস্ত এবং বাস্তুচ্যুত করার ভয়াবহ শোকা’ক অধ্যায় নিয়ে রচিত।
‘আই স’ রামাল্লা’- ‘আমি রামাল্লা দেখেছি’ মাওরিদ বারঘাওতির আত্মজীবনী। এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছেন- ‘এ বইটি ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের ওপর লেখা সর্বোত্তম বইগুলোর একটি। ১৯৬৭ সালের ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়। ৩০ বছর পর এ লেখক কায়রো থেকে নিজ জন্ম শহর মাওরিদে ফিরে আসেন। ‘মর্নিং ইন জেনিন’ ১৯৪১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আক্রমণ ও দখলদারি নিয়ে লেখা ঐতিহাসিক উপন্যাস। এর লেখক সুসান আবুল হাওয়া একজন শিশু ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু। বইটি ২০টি ভাষায় অনূদিত এবং ১০ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।
তা ছাড়া লেখক ও রাজনীতিবিদ গাসান কানাফানি রচিত ‘মেন ইন দ্য সান’ এবং ‘গাজা রাইটস ব্যাক’ ছোটগল্প সঙ্কলন। এর স¤পাদক রিফাত আলরিয়া। এটি উল্লেখযোগ্য ফিলিস্তিনি সাহিত্য।
শহিদ আব্দুর রহিম মাহমুদ ‘শহিদ’ কবিতায় লিখেন;
‘আমার জাতিকে আমি রক্ষা করব তলোয়ারের ধার দিয়ে/ তখন তারা বলবে, আমিই প্রকৃত বীর’। মিসরীয় কবি মাহমুদ তাহার ‘ফিলিস্তিন’ বিখ্যাত একটি কবিতা। সিরিয়ার কবি নিযার কোববানির ‘আমার একটি বন্দুক চাই’ কবিতায় লিখেন : ‘এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো।/ শান্তি চুক্তির গল্প সব নাটক। সমঝোতার নামে সব নাটক।/ ফিলিস্তিনে একটাই পথ, সেটা হলো বন্দুকের নল’।
১৯৬৭ সালে পশ্চিমতীর, গাজা, সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি ইসরাইল কর্তৃক দখল করা হয়। এ সময় ফিলিস্তিনি লেখকরা বক্তব্যধর্মী সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়ে। প্রতিরোধ সাহিত্যধারাও গতিময় হয়। বিশ শতকের শুরুতে ইব্রাহিম তুক্কান, আবদুর রহিম মাহমুদ ও আবদুল করিম আল কারমি প্রমুখ কবিরা পরাশক্তির জায়নবাদ প্রীতির তীব্র সমালোচনা মুখর হন। ফাদওয়া তুক্কান এদের প্রধান পূর্বসূরি। এ সফল সাহিত্যিকের ছয়টি উপন্যাস বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৭৫ সালে তার ‘দা ওয়াইল্ড থর্ন’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। এতে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনের যাপিত জীবন চিত্রিত হয়।
তা ছাড়া যাদের হাতে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়, তারা হচ্ছেন ‘রওভি ইয়াসিন আল খালিদি, নাজিব নাসার, মুহাম্মদ ইসআফ আননাশনাশিবি এবং খলিল আস সাকাকিনি।
ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী এডওয়ার্ড সাঈদ ২০ শতকের অন্যতম চিন্তাবিদ ও প্রাচ্যবাদ তাত্ত্বিক। তার মৌলিক গ্রন্থ ‘ওরিয়েন্টালিজম’ ১৯৭৮।
মাহমুদ দারবিশ (১৯৪১-২০০৮) ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি। তিনি পিএলও মাসিক জার্নালের সম্পাদক এবং গ্রুপের গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন। বৈরুত ও প্যারিসে ২৬ বছর নির্বাসিত জীবন যাপনের পর রামাল্লায় বাস করতেন। তাকে আরব বিশ্বের সাহিত্য জগতের কণ্ঠস্বর বলা হয়। তার কবিতা ফিলিস্তিনি আত্মপরিচয় এবং মাতৃভূমির দখলদারিত্ব প্রতিহতে অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। ‘একজন ফিলিস্তিনি প্রেমিক’ কবিতায় কবি দারবিশ লিখেন : তার চোখ জোড়ায় ফিলিস্তিন/ তার নাম ফিলিস্তিন/ তার পোশাক আর তার দুঃখগুলো ফিলিস্তিন/ তার মাথায় বাঁধা রুমাল, তার পা জোড়া/ তার শরীর ফিলিস্তিন/ তার কথা, তার নীরবতা ফিলিস্তিন/ তার জন্ম এবং মৃত্যু ফিলিস্তিন।
ফিলিস্তিনের এ কালো বিষাদের মাঝেও কবির জীবনে ঘটে গেছে এক মজার ঘটনা। তার ইহুদি গুপ্তচর প্রেমিকা রিতাকে নিয়ে লিখেন :
‘আমি আমার জাতির সাথে বেইমানি করে, আমার শহর এবং তার পরাধীনতার শিকলের বেদনা ভুলে গিয়ে হলেও তোমাকে ভালোবাসি’। কিন্তু কবি যখন জানলেন প্রিয়তমা রিতা মোসাদের গুপ্তচর।
তখন কবি ‘রিতা ও রাইফেল’ শিরোনামে কবিতায় লিখেন :
‘রিতা আর আমার চোখের মাঝখানে/একটা রাইফেল/আর যে-ই রিতাকে চেনে/ হাঁটু গেড়ে খেলে/ সেই মধু- রঙের চোখে সৌন্দর্যের কাছে/ আর আমি রিতাকে চুমু খেলায় …
রিতা আর আমার চোখের মাঝখানে/ একটি রাইফেল।
ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামের সাহিত্য বিশ্ববিবেক জাগ্রত করার সাহিত্য। বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলেই নির্যাতিত ফিলিস্তিনবাসী ইসরাইল জায়নবাদী শক্তি সৃষ্ট জেলখানার জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫৩:১৯ ২৫৯ বার পঠিত