উপমা না বুঝলে সাহিত্য বোঝা দায়

প্রচ্ছদ » সাহিত্য ও সংস্কৃতি » উপমা না বুঝলে সাহিত্য বোঝা দায়
শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৩



---

: আবুল বাশার :

এই লেখায় আমরা কবি আর বিজ্ঞানীর দেওয়া-নেওয়া এবং ‘সামীপ্য’ নিয়ে কথা বলব। ‘যেন’ শব্দটি ব্যবহার করে জীবনানন্দ কীভাবে উপমার সাহায্যে বৈজ্ঞানিক সত্যকে ‘গোচর’ করাচ্ছেন আমরা দেখব। এ ব্যাপারে আমরা ভাষাবিজ্ঞানী কিংবা ভাষা-দার্শনিককে সাক্ষ্যদানের হেফাজতে রাজসম্মান দিয়েই নিতে পারি। আমরা হ্বিটগেনস্টাইনকে এক ঝলক আহ্বান করতে পারি। ভাষার সঙ্গে চোখের তুলনা করেছেন তিনি। আপতত দেখা যাক, ‘যেন’ শব্দটির কী-প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন কবি জীবনানন্দ দাশ, সেখানে বিজ্ঞানই-বা কীভাবে রয়েছে। ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধটিতে জীবনানন্দ প্রচুর উপমার ব্যবহার অবলীলায় করেছেন, তার কোনো তুুলনা আমাদের সুবিদিত নন্দনে কোথাও নেই।

কথা হলো, সমাজ-মতবাদ বা রাজনৈতিক মতবাদ ও সমাজ-সমস্যাকে কবি বা সাহিত্যিক তাঁদের লেখায় কী কায়দায় প্রকাশ করবেন, সেই প্রসঙ্গে বলছেন জীবনানন্দ। কবি লিখেছেন, ‘আমি বলতে চাই যে, কবিতা সমাজ বা জাতি বা মানুষের সমস্যাখচিত’ অভিব্যক্ত সৌন্দর্য হবে না। তা হতে বাধা নেই। অনেক শ্রেষ্ঠ কাব্যই তা হয়েছে। কিন্তু সে সমস্ত চিন্তা, ধারণা, মতবাদ, মীমাংসা কবির মনে প্রাক-কল্পিত হয়ে কবিতার কঙ্কালকে যদি দেহ দিতে চায় কিংবা সেই দেহ চায় আভা, তাহলে কবিতা সৃষ্টি হয় না ‘পদ্য লিখিত হয় মাত্র’ ঠিক বলতে গেলে পদ্যের আকারে সিদ্ধান্ত, মতবাদ ও চিন্তার প্রক্রিয়া পাওয়া যায় শুধু।’

উদ্ধৃতিটি আরো কিছুটা লম্বা হবে। পুরো উদ্ধৃতি দেব না। কিন্তু যতটা না দিলেই নয়, সেটাকে আমরা তিন দফায় ভাগ করে নিয়েছি।

অতঃপর কবি বলছেন, ‘…কিন্তু আমি আগেই বলেছি কবির প্রণালি অন্য রকম, কোনো প্রাকনির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদের জমাট দানা থাকে না কবির মনে’ কিংবা থাকলেও সেগুলোকে নিরস্ত করে থাকে কল্পনার আলো ও আবেগ; কাজেই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভেতর সুন্দরীর কটাক্ষের পেছনে শিরা, উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন।’

উদ্ধৃতাংশের শেষ শব্দটি কবি চয়ন করেছেন, ‘যেন’ অব্যয় রূপে। এখানে ‘যেন’ মানে যেমত কিংবা যেমন ‘এটি মতোরই বিকল্প শব্দ; তুলনামূলক শব্দ। তার ঠিক দুটি শব্দের আগে ‘মতো’ শব্দটিও আছে। তুলনামূলক তার কী বিচিত্র সমাবেশ!

লক্ষ্য করার বিষয়, সুন্দরীর সুন্দর কটাক্ষের যে-সৌন্দর্য তার পেছনে রয়েছে শরীরবিজ্ঞানের প্রণালি ‘আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, বিজ্ঞানের সেই প্রণালি বা প্রমাণ ভাষার উপমা দ্বারা লুকোনো বা ঢাকা’ সেই বৈজ্ঞানিক প্রণালি বা প্রমাণ আমাদের চোখে পড়ে না। কিন্তু আসলে আমরা কী কী লুকোলাম বা সুপ্ত করে রাখলাম? সুপ্ত রইল আমাদের চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ। ‘যেন’ অব্যয়টির কারসাজিটি একবার ভেবে দেখুন হে প্রিয় পাঠক।

বলবার কথা এই যে, উপমা যখন যুক্তি বা প্রতিপাদিতার কাজে নামে, তখনো তার আচরণ অনবদ্য। বস্তুত সে প্রমাণ বা প্রতিবাদন করতে পারে না। কিন্তু তার প্রমাণের চেষ্টাটা অদম্য ও আন্তরিক ‘উপমা আসলে ভাষার স্বাভাবিক অলংকার। এ কথাটি আমাদের মনে রাখা চাই। উপমার এই শক্তি অসম্ভব ভালো চিনতেন মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন’ তিনি চিরকালের বড় বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তাঁর ব্যবহূত উপমা মহাকবিদের মতোই শক্তিশালী। ঐ উপমা তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তির অনন্যতা আজও আমাদের অবাক করে চলে’ আমরা স্তম্ভিত হয়ে বিজ্ঞানীর অন্তঃকরণকে দেখতে পাই। তার জাতি-আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করেছে ঐ উপমা।

অ্যালবাট আইনস্টাইন ‘একজন ইহুদি ঠিক কেমন’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ইহুদি গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য কী? প্রথমত ইহুদি বলতে কী বোঝায়? এই প্রশ্নের উত্তর দ্রুত দেওয়া যায় না। এর সবচাইতে সু¯পষ্ট উত্তর হচ্ছে : একজন ইহুদি এমন একজন মানুষ, যিনি ইহুদি-বিশ্বাসকে প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেন। এই উত্তরের ভাসা ভাসা বৈশিষ্ট্য সহজেই এক সরল তুলনার দ্বারা বোঝা যেতে পারে। আমরা এই প্রশ্ন করছি : শামুক কী?…উত্তর হতে পারে : শামুক একধরনের প্রাণী, যা শামুক-খোলের মধ্যে বাস করে। এই উত্তর একেবারেই বোধগম্য এবং নিশ্চিতভাবে স¤পূর্ণ নয়। কারণ শামুকের খোল শামুকেরই তৈরি একটি পদার্থবিশেষ। অনুরূপে, ইহুদি-বিশ্বাস ইহুদি-সম্প্রদায়েরই এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ফল। উপরন্তু জানা আছে যে, কোনো শামুক তার খোল পরিত্যাগ করলেও শামুকই থেকে যায়। যে ইহুদি তার বিশ্বাস (শব্দটির রীতিসিদ্ধ অর্থে) পরিত্যাগ করেন তিনিও অনুরূপ অবস্থায় বিরাজ করেন। তিনি একজন ইহুদিই থেকে যান।’ অনিল দাসের বই থেকে নেওয়া। এ কথাগুলোর সামাজিক ও জাতিগত এবং ঐতিহাসিক তাতপর্য আমি এখানে ব্যাখ্যা করব না। আমি শুধু পাঠককে লক্ষ করতে বলব, শামুকের সঙ্গে জাতি বা সম্প্রদায়ের তুলনা। উপমেয় হলো জাতি, উপমান হলো শামুক। বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার।

উপমা নিয়ে মস্তবড় বই লেখা যায়। কিন্তু আজ এই পর্যন্ত। শুধু বলার, উপমায় যে-জন বিস্মিত হতে জানে না, তার সাহিত্য-বিজ্ঞান বা দর্শন কোনো জগতেই ঠাঁই না থাকাই জরুরি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫১:৪৮   ৮৯ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য ও সংস্কৃতি’র আরও খবর


ভোলায় দিনব্যাপী ঈদ আনন্দমেলা
দিলরূবা জ্যাসমিনের উপন্যাস “তবুও ছুঁয়ে যায়”- এর মোড়ক উন্মোচন
আজকের ভোলা প্রতিনিধি কবি নুরুল আমিনের কাব্যগ্রন্থ ‘ধান শালিকের কাব্যমালা’ প্রকাশ
দৌলতখানের কৃতি সন্তান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কবি হায়াত মাহমুদ অসুস্থ ॥ সকলের দোয়া প্রার্থী
ভোলায় বর্নাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হল গণজাগরনের সাংস্কৃতিক উৎসব
ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের সাহিত্য
কারার ঐ লৌহকপাট
উপমা না বুঝলে সাহিত্য বোঝা দায়
ভোলার দুই দিনব্যাপী সাহিত্য মেলার শুরু
উপন্যাস : রীতি ও প্রকৃতি



আর্কাইভ