ভোলার উপকূলের দুর্গম জনপদে বাল্য বিবাহের ফাঁদে কিশোরীরা

প্রচ্ছদ » জেলা » ভোলার উপকূলের দুর্গম জনপদে বাল্য বিবাহের ফাঁদে কিশোরীরা
বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭



---
ছোটন সাহা ॥
চরাঞ্চলে নিরাপত্তা আর অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার নিয়মসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করে জেলে বধু বিবি সাফিয়া সরলমনে বলেন, নানা লোকে নানা কথা বলে, মেয়ে বুড়ো হয়ে গেছে, এখনি বিয়ে না দিলে কেউ বিয়ে করবো না, তাই ১৫ বছর বয়সে বড় মেয়ে রিয়া ও ১৪ বছরে নুর জাহানকে বিয়ে দিয়েছি, এখন ৫ম শ্রেনীতে পড়–য়া মেয়ে সুরমাকে (১২) বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। বেশ কিছু সমন্ধও এসেছে, হয়ত বর্ষার পরেই সব ঠিক-ঠাক হলেই বিয়ে দেবো।
একই গ্রামের লোকমানের স্ত্রী রেহানা ৩ মেয়েকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তিনি বলেন, বড় মেয়ে পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ে। এখন লেখা পড়া বন্ধ করে দিয়েছি, বিয়ের বয়স হয়ে গেছে, এখন বিয়ে না দিলে পরে কেউ বিয়ে করবো না।
ভোলার দৌলতখানের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ মদনপুর ইউনিয়নের চর টবগী গ্রামের সাফিয়া ও রেহানার মত অনেক অভিভাবকের গল্প এমনই যারা অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ভোলার চরাঞ্চলে অভিভাবকদের অসচেতনা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, সরকারী প্রচার-প্রচারনার না থাকা ও কুসংস্কারের কারনে বাল্য বিবাহ দিন দিন বেড়েই চলছে। বাল্য বিয়ের এ চিত্র শুধু মদনপুরের নয়, উপকূলের দুর্গম জনপদের চিত্র সব একই ধরনের। যারা বাল্য বিয়ে ছাড়া কিছু বোঝেন না, সামাজিক কু-সংস্কারে আটকে আছে চরের পরিবারগুলো। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপকূলের বিচ্ছিন্ন চরে বাল্য বিবাহ ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। ১৩/১৪বছর বয়সেই বাল্য বিবাহের শিকার হচ্ছেন কিশোর-কিশোরীরা। যে বয়সে এসব কিশোর-কিশোরীদের বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সেই তাদের বাল্য বিবাহের ফাঁদে পড়তে হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে অন্যদিকে গর্ভকালীর অবস্থায় মৃত্যু ঝূঁকিও বাড়ছে। কখনও আবার মারাও যাচ্ছে কিশোরীরা। খোজ নিয়ে দেখো গেছে জেলার মদনপুর, মেদুয়া, মাঝের চর, রামদাসপুর, চর জহিরউদ্দিন, চর কচুয়া, কলাতলীর চর, চর তাজাম্মেল, ঢালচর, কুকরী-মুকরী, চর পাতিলা, হাজিপুরসহ ১৭ চরে বাল্য বিয়ের ধুম।
কখনও নাচ-গান আর আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে আবার কখনও নিশ্চুপে এসব চরাঞ্চলে বাল্য বিবাহ দেয়া হয় কিশোর-কিশোরীদের। ছেলেদের বেলায় ১৫/১৬ আর মেয়েদের ১২/১৩বছর বয়সেই চরের প্রত্যেকটি পরিবারে কিশোরীরা বাল্য বিবাহের ফাদে পড়ছেন। দুর্গম এলাকায় বাল্য বিবাহ বন্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন না করায় এ চিত্র দিন দিন ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে।
অল্প বয়সের শিশুদের বিয়ে দেয়ার কারনে মাঝে মধ্যেই গর্ভকালীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ আবার অপুষ্টিতে ভুগে শারিরিক ভারসম্য হারিয়ে ফেলছেন। সামাজিতভাবে নিরাপত্তাহীনতা আর বয়স বেশী হলে মেয়েদের বিয়ে দেয়া যাবেনা এমন কুসংস্কার চরাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ায় বাল্য বিবাহ রোধ করা যাচ্ছে না চরে।
জেলে জাহাঙ্গিরের স্ত্রী বিবি সাফিয়া আরো জানালেন, আমার ঘরে ৬ মেয়ে, ছেলে নেই। ২ মেয়েকে পার করে দিয়েছি, এখনও ৪ মেয়ে আছে। একজন বিয়ের লাখ বাকিরা ছোট। তবে ২/৩ বছর পার হলেই বছর ঘৃুরে শাহনাজ, তানজু, সুমাইয়ার বিয়ে দেয়া হবে। কি করবো নদীর ইনকাম, টাকা-পয়সা নেই, আমি মারা গেলে মেয়েদের দেখতে কে, তাই যত তাড়াতি পারছি অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছি।
জেলে হারুন বলেন, সারাদিন নদীতে মাছ শিকার করি, স্ত্রী ঘরে রান্না-বান্না আর ক্ষেত খামার দেখাশুনা করে। মেয়েদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়। গরীব মানুষ, ভয় তো আছেই, তাই যত দ্রুত মেয়েকে বিয়ে দেয়া যায়। মোশারেফ বলেন, চরে প্রত্যেক ঘরে ঘরে বাল্য বিবাহ হচ্ছে। এটা নিয়ম হয়ে গেছে। আগে বাপ-দাদারা করেছে এখন আমরা।
১৫ বছর বয়সে ২ সন্তানের জননী জান্নাত। স্বামী ইব্রাহিম, পেশায় জেলে। জান্নাত বলেন, বাবা-মা বাধ্য করেছে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে, কিন্তু এখন পরিবার সামলাতে পারছিনা, সারাক্ষন বিভিন্ন ব্যাধি আর দুর্বলতা নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।
১৭ বছর বয়সে ২ সন্তানের মা হারুনের স্ত্রী তাসনুর। কাজ করার সামার্থ যেন হারিয়ে গেছে তার, তিনি বলেন, বহু কষ্ট করে বাবা মা বিয়ে দিয়েছে, আমরা দরিদ্র ঘরের সন্তান, তাই বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয়েছে।
মদনপুর চরের বাল্য বিবাহের শিকার কিশোরী শাহনাজ (১৭)। এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে তার, বিয়ে হয়েছে ৩ বছর আগে, এখন আরেক সন্তানের মা হতে যাচ্ছেন তিনি। অপুষ্টিসহ নানা রোগে আক্রান্ত তিনি। স্বামী আবদুল জলিল। পেশায় জেলে। শাহানাজ বলেন, বাবা-মা ভূল করে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছে, আমি এ ভূল করবো না ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা করিয়ে নির্ধারিত সময়ে বিয়ে দেবো।
কামালের স্ত্রীর বিবি হাজেরা জানালেন, ৫ মেয়েকে নিয়ে বিপদের মধ্যে আছেন। এরমধ্যে আবার এক মেয়ে প্রতিবন্ধি। কিভাবে এদের বিয়ে দেবেন সে চিন্তা যেন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ৩ মেয়ে স্কুলে পড়ে, বড় মেয়ে শারমিন ভোলা শহরে এক আতœীয় বাড়িতে থেকে ৭ম শ্রেনীতে পড়ে। কিন্তু এখনও তার বিয়ে দিতে পারিনি, টাকা পয়সা নেই বিয়ে দিতেও পারছিনা আবার পড়ালেখা করাতে পারছিনা। তবে খুব শিগ্রই এদের বিয়ে না দিলে সমাজে টিকে থাকা যাবেনা, চরে ১৫ এর বেশী বয়স হলে কারো বিয়ে হয়না, সবাই বেশী বুড়ো হয়ে গেছে।
সেরাজল জানান, কিছুদিন আগে চর টবগী এলাকায় বাল্য বিবাহের শিকার কিশোরী শাহিনুর (১৪) সন্তান জ¤œ দিতে গিয়ে মারা গেছেন। এরআগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবুও বাল্য বিবাহ কমছে না, চরের প্রত্যেক ঘরে ঘরে যেন বাল্য বিবাহ চলছে।
চরের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেলো সাহিদা, রহিমা, শাহিনুর, রেহানা, কুলসুম ও হাজেরার মত অনেক নারী এখন মেয়েদের বাল্য বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছেন।
যে বয়সে কিশোরীদের খেলা ধূলা আর বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সেই বাল্য বিয়ে শিকার হয়ে সংসার করছেন তারা। আর কখনও সন্তার ধারন করতে গিয়ে মৃত্যুর কোলেও ঢলে পড়ছেন। কিন্তু এসব মৃত্যু অভিভাবকদের কাছে পৌছালেও যেন তারা ভয় পায়না, দারিদ্রতার কারনেই বিয়ের ফাদে পড়ছে কোমলমতী শিশুরা।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে আরো জানা গেছে, মূল বয়স গোপন করে বয়স বাড়িয়ে দিয়ে বাল্য বিবাহ দিতে উৎসাহিত করে তোলছেন কাজীরাও। তারা সামান্য কিছু টাকার লোভে কিশোরীদের বাল্য বিবাহ পড়াচ্ছেন।
এ বিষেয় সচেতন নারী মমতা বেগম বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় কাজীদের বাল্য বিবাহ পড়াতে নিশেধ করি, কিন্তু তারা কারো কথা শোনেনা, নিজেদের মত করে গ্রামে গ্রামে বাল্য বিবাহ পড়াচ্ছে।
চর ঘুরে তথ্য সংগ্রহকালে অনেক কিশোরী ও তাদের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বাল্য বিবাহ না দেয়া কথাও জানান। তাদের মধ্যে এমনি একজন তাসনুর বলেন, বিয়ে দেয়ার প্রকৃত বয়স হলেই ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেবো, আমাকে দেখে অনেকেই এ কাজটি করবো। তখন কিছুটা হলেও বাল্য বিবাহ কমে যাবে।
বাল্য বিয়ে ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সহসভাপতি ও সাংবাদিক আদিল হোসেন তপু বলেন, ওঠান বৈঠক সহ বিভিন্নভাবে গ্রামের মানুষকে বাল্য বিবাহের বিষয়ে সচেতর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে অন্যদেরও এসব বাল্য বিবাহ রোধে এগিয়ে আসা উচিত।
বাল্য বিয়ে ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এ্যাড: সাহাদাত শাহিন বলেন, বাল্য বিবাহ আমাদের দেশের দীর্ঘ দিনের একটি সামাজিক অভিশাপ। বাল্য বিবাহের অভিশাপে একজন নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে দেয় না। বাল্য বিবাহ বন্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকলেও সমাজের সাধারণ মানুষের জনসচেতনতা না থাকার কারণে এর কার্যকরতা তেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা বাল্য বিবাহের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে দ্বীপজেলা ভোলায় এ্যাডভোকেট, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে “বাল্য বিয়ে ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করি। এই সংগঠনটির আত্মপ্রকাশের পর থেকে বাল্য বিয়ে বন্ধে ও সচেতনতা বাড়াতে অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করে কাজ করে আসছি। চরাঞ্চলে বাল্য বিবাহ বন্ধে প্রচার-প্রচারনা আর সামাজিক সচেতনতার অভাবের কারনে কোমলমতী শিশুরা শিক্ষা গ্রহন না করে বাধ্য হয়েই বিয়ের শিকার হয়ে হারিয়ে ফেলছেন উজ্জল ভবিষ্যত। তবে সরকার যদি গ্রাম-গঞ্জে বাল্য বিয়ের কুফল সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রচার-প্রচারনা চালায় তবে বাল্য বিয়ের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করার সম্ভব হবে।
মদনপুর ইউপি চেয়ারম্যান নাছির উদ্দিন বলেন, মদনপুরে প্রায় বাল্য বিয়ে খবর পাই সেগুলো বন্ধ করে দেই, তাদের জ¤œ সদনও দেয়া হয়না।
এ ব্যাপারে ভোলার জেলা প্রশাসক মো: সেলিম উদ্দিন বলেন, শহর বা উপজেলা পর্যায়ে বাল্য বিয়ের খবর পেলেই তাৎক্ষনাত তা বন্ধ করে দেয়া হয়, পাশাপাশি দুর্গম এলাকাতেও খবর পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়, তবে কিছু সময় ঠিকমত খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
বাল্য বিয়ে বন্ধে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পর্যায়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলমান আছে। জেলার সাত উপজেলায় গত এক বছরে অন্তত শতাধিক বাল্য বিয়ে বন্ধ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০:২৩:১৭   ১৪৫১ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

জেলা’র আরও খবর


বিজয়ী হলে মডেল উপজেলা হিসেবে গড়ে তুলবো: মোশারেফ হোসেন
মটরসাইকেল ও উড়োজাহাজ প্রার্থীর গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ
ভোলা পৌরশহর ও বাজারে নেই পাবলিক টয়লেট ॥ জনগনের ভোগান্তি চরমে
মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় বাগদার রেণু শিকারের মহোৎসব
শিক্ষা বিমুখ জেলেপল্লীর অধিকাংশ শিশু, জড়াচ্ছে বাপ-দাদার পেশায়
বেসরকারিভাবে শতভাগ পাশের হারের শীর্ষে হালিমা খাতুন বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়
বিভাগীয় পর্যায়ে লোক ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যে ভোলার মেয়ে অহনার ১ম স্থান অর্জন
আনারস মার্কায় ভোট দিবেন এটাই আপনাদের কাছে আমার চাওয়া: মোশারেফ হোসেন
নির্বাচন হবে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ, সবাই কেন্দ্রে এসে ভোট দিবেন: মোহাম্মদ ইউনুছ
দালালদের খপ্পড়ে পড়ে নিঃস্ব জীবন ॥ চরফ্যাশন উপজেলার পাচঁ প্রবাসীর আর্তনাদ!



আর্কাইভ