ছাত্র রাজনীতির আড়ালে খুনের পাঠশালা

প্রচ্ছদ » মুক্তমঞ্চ » ছাত্র রাজনীতির আড়ালে খুনের পাঠশালা
বুধবার, ১৯ জুলাই ২০১৭



:মোমিন মেহেদী :

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চেষ্টা না করে কেবল মিলিয়ে দেয়ার রাজনীতি করে যাচ্ছেন। যা হয়তো তাদেরকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সুযোগ করে দিলেও ভবিষ্যতে তৈরি হবে ভয়াবহ হামলা-মামলার রাজনীতি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতিকে খুক কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অধিকার আন্দোলন জোটের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের ৩ বছর। এই সময়ে আমার দেখা ক্ষতিকারক রাজনীতির সবচেয়ে বড় স্থান হলো লোভী-লম্পট-টাউট-বাটপার-যুদ্ধাপরাধী-জামাত-শিবির-জঙ্গী চক্রের সদস্য শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের অংশগ্রহণে নির্মিত অরাজকতা, অন্যায় আর অপরাধের স্বর্গরাজ্য বানানোর চেষ্টা। এই চেষ্টায় অবারিত সহযোগিতা করেছে ছাত্র শিবির-জামাত-জঙ্গীসহ দেশ বিরোধীচক্র। সেই সহযোগিতাকে কাজে লাগিয়ে অন্যায় আর অপরাধের রাজত্ব তৈরির চেষ্টা আজো যে সারাদেশে অব্যহত আছে, তার প্রমাণ হলো বিয়ানী বাজার ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরে বিয়ানীবাজার কলেজ কক্ষে গুলিতে নিহত হয়েছে ১ জন।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চোখের সামনে অনেক বড় বড় অন্যায় আর অপরাধের রাজত্ব নির্মাণে নিবেদিত নিকৃষ্ট মানষিকতার শিক্ষার্থীদের লড়াই দেখেছি। ২০০৪ থেকে ক্রমাগত তৈরি হওয়া অন্যায় আর অপরাধের রাজনীতি দেখতে দেখতে কান্ত হয়ে অবশেষে সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজের শ্রেণীকক্ষে গুলি করে খালেদ আহমদ লিটু (২৩) নামে একজনকে হত্যা করা হয়েছে বলে বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে ক্যাম্পাসে বিবদমান দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি ও সংঘর্ষ হয়। নিহত লিটু ওই কলেজের ছাত্র নয়। সে পেশায় একজন মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী ও স্থানীয় ছাত্রলীগের পাভেল গ্রুপের সমর্থক। কলেজটি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের নির্বাচনী এলাকায় অবস্থিত। আর নিহত লিটু শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিপক্ষ গ্রুপের সমর্থক বলে জানা গেছে। এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর এলাকার একটি কলেজের শ্রেণীকক্ষে এ ধরনের ঘটনা ঘটায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রীর এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের অস্ত্রের মহড়ায় অভিভাবকদের মধ্যেও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে লিটু কলেজের ছাত্র না হয়েও কী করে শ্রেণীকক্ষে অবস্থান করছিল, সে প্রশ্নও এখন অনেকের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘটনার পর বিয়ানীবাজার থানা পুলিশ কামরান, ফাহাদ ও এমদাদুর নামের তিনজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তারা পাভেল গ্রুপের কর্মী বলে জানা গেছে। কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, লিটু নিহত হওয়ার আগে কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পাভেল গ্রুপ ও পল্লব গ্রুপের অনুসারীদের মধ্যে হাতাহাতি-সংঘর্ষ হয়। এতে কলেজ ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কলেজে পরীক্ষার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘ছাত্রলীগের বিবাদমান দুটি গ্রুপের অনুসারীদের মধ্যে সকালে হাতাহাতি হয়। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। দুপুর ১২টার দিকে ইংরেজি বিভাগের কক্ষে হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা যায়। দ্রুত সেখানে গিয়ে এক যুবককে রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখি। এ সময় কক্ষটিতে কেউ ছিল না। গুলির শব্দের পরপরই জিআই পাইপ হাতে তিন যুবককে দৌড়ে পালাতে দেখেছেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। লিটু কলেজের ছাত্র নয়। দুপুরের দিকে হঠাৎ ইংরেজি বিভাগে গুলির শব্দ শোনা যায়। পরে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত এক যুবক পড়ে আছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হত্যাকান্ডের পর কলেজ কাউন্সিলের জরুরি বৈঠক ডেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে পরীক্ষা যথারীতি চলবে। এদিকে হত্যাকান্ডের পর ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ পরস্পরকে দায়ী করছে। জেলা ছাত্রলীগের আপ্যায়নবিষয়ক সম্পাদক পাভেল মাহমুদ নিহত লিটুকে তার গ্রুপের কর্মী দাবি করেছেন। যেখানে লিটু শিক্ষার্থী-ই না; সেখানে নিজের গ্রুপের নেতা দাবীর মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে অন্ধকার। এই অন্ধকারের রাস্তায় অগ্রসর হতে হতে তারা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশকে কালো অন্ধকারে ঢেকে দিতে এমন নিকৃষ্ট কাজ করেই যাবে। আবার চোরের মার বড় গলার মত করে বলবে- পল্লবের ক্যাডাররাই লিটুকে হত্যা করেছে। বেলা ১১টায় পল্লব গ্রুপের সঙ্গে তার নেতাকর্মীদের ঝগড়া হয়। এ সময় পল্লব গ্রুপের ক্যাডার শাহেদ অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দেয়। পরে সিনিয়রদের নিয়ন্ত্রণে পরিস্থিতি শান্ত হয়। দুপুরের দিকে শুনতে পাই, প্রতিপক্ষের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে লিটু মারা গেছে। অন্যদিকে অন্যপক্ষ বলছে যে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। ঘটনার সময় আমি কলেজ ক্যাম্পাসেই ছিলাম না। দুটি স্ট্যান্ডের বিরোধ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় পুলিশ প্রশাসনের ডাকা বৈঠকে আমি ছিলাম। প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করতেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আসলে পাভেল গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়েছে লিটু। ফাহাদ, কালো কামরান ও এমদাদের নেতৃত্বেই লিটুকে খুন করা হয়েছে। ঘটনার পর ফাহাদকে অস্ত্র হাতে পালিয়ে যেতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম সংগঠক রাজনৈতিক শক্তি। এই শক্তির মধ্যে ৪৭ বছর পর যারা পক্ষ প্রতিপক্ষের জন্ম দিচ্ছে, তারা শুধু দেশের শত্রু নয়; মানুষেরও শত্রু। এই শত্রুদেরকে কোন না কোনভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। তা  না হলে লোভী-লম্পট-টাউট-বাটপার-যুদ্ধাপরাধী-জামাত-শিবির-জঙ্গী চক্রের সদস্য শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক আস্ফালন চলতে চলতে বলতে শুরু করবে- ‘আমরা সবাই তালেবান/বাংলা হবে আফগান।’ এর আগেই গড়ে তুলতে হবে বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধতা; যারা রাজনীতির নামে কোন অপরাজনীতি সহ্য করবে, দুর্নীতি-অন্যায় আর অপরাধের রাস্তা দিয়ে ভুলেও হাঁটবে না। আর এতে করেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, সমন্বয়হীনতা, দেশজুড়ে সংঘর্ষের রাজনীতি থেকে নিষ্কিৃতি পাবে বাংলাদেশ।
বর্তমান ছাত্রলীগের রাজনীতি অন্যায় আর অপরাধের পাশাপাশি সহিংসতার রাস্তায় অগ্রসর হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই হয়তো অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, দেশজুড়ে সংঘর্ষের ঘটনায় বার বার গণমাধ্যমের শিরোনামে আসছে ছাত্রলীগ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে বইছে সুবাতাস, তখন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের এমন আচরণ ভাবিয়ে তুলেছে ছাত্র সমাজসহ সারাদেশের প্রতিটি নাগরিককে। কেননা, নির্মমতার রাস্তায় অগ্রসর হওয়ার কারনে কথায় কথায় খুনের রাজনীতিতে তারা ব্যপক ক্ষমতাধর। হয়তো এ কারনেই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সিলেটের বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজে ছাত্রলীগের ২ পক্ষের সংঘর্ষে গুলিতে একজন নিহত হয়েছে। অন্যদিকে ১ লাখ টাকা চাঁদা না দেয়ায় টেম্পুচালক স্বামীকে বেঁধে নববধূকে (২২) ধর্ষণ করেছে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন হোসেন মোল্লা।  যদিও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিনের পুরনো বলয় ভেঙে নতুন ধারায় চলতে শুরু করেছে ছাত্রলীগ। সে কারণে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই ছাত্রলীগের প্রভাবশালী এক সভাপতির শক্তিশালী সিন্ডিকেটের অশুভ ছায়া থেকে মুক্ত করতে ছাত্রলীগে কাজ শুরু হয়েছে। সোহাগ ও জাকিরের জীবনাচরণ এবং তাদের খরচের অর্থের উৎস নিয়ে বৈঠকে প্রশ্ন তোলেন সংগঠনের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। শুধু তা-ই নয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্মেলন আয়োজনের দাবিও তোলেন কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা। চলতি মাসের ২৬ তারিখের পর শেষ হচ্ছে সাইফুর রহমান সোহাগ ও এসএম জাকির হোসাইনের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিটির মেয়াদ। কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশ নির্ধারিত সময়ে সম্মেলনের পক্ষে। তবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সম্মেলনের পক্ষে নয় আওয়ামী লীগের অপর একটি বড় অংশ। তবে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি আগামী নির্বাচনে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়েও দ্বিধা রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে। আমি মনে করি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রক বলে এক দশক ধরে পরিচিত বর্তমান ও সাবেক ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘পুরনো চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে পড়ছে দিন দিন। ছাত্রলীগের কিছু সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্বে নতুন মেরুকরণ তৈরি হচ্ছে ছাত্রলীগে। এ প্রভাব পড়ছে সংগঠনে। ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক এক শীর্ষ নেতা, যিনি সংগঠনটির মূল নিয়ন্ত্রক বলে পরিচিত ছিলেন, তার সঙ্গে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির নেতাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আগের মতো ছাত্রলীগের সঙ্গে নিবিড় সখ্য নেই ঐ নেতার। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা কেবল কাগজে-কলমেই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সংগঠনের নিউকিয়াস ছিলেন সাবেক ঐ শীর্ষ নেতাসহ আরো কিছু সাবেক নেতা। কিন্তু অতিসম্প্রতি ঐ শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ কমায় আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে। অবশ্য ঐ শীর্ষ নেতার ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, তিনি নিজে থেকেই ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিষয় থেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন; চেষ্টা করছেন ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট বিষয় থেকে দূরে সরে যেতে। এ কারণে পুরনো বলয়ের বদলে নতুন মেরুকরণের আলামতও দেখা যাচ্ছে ছাত্রলীগে। ফলে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা বাড়তে শুরু করেছে সোহাগ-জাকিরের। এ কারণে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংঘর্ষ-হানাহানির ঘটনাও ঘটছে।
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি এবং উপদেষ্টা, জাতীয় শিক্ষাধারা

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৫০:৪৯   ৩১৩ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

মুক্তমঞ্চ’র আরও খবর


একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা কেনো?
ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতি
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে
আমার দেখা নিউইয়র্ক শহর
মুদ্রাস্ফীতিতে বাংলাদেশ
রোগীর সম্পৃক্ততাই তার নিরাপত্তা
বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের প্রেরণা
বেদনায় ভরা দিন
অর্থনীতিতে নার্সারিশিল্প
এলসি, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও উত্তরণ



আর্কাইভ