রোগীর সম্পৃক্ততাই তার নিরাপত্তা

প্রচ্ছদ » মুক্তমঞ্চ » রোগীর সম্পৃক্ততাই তার নিরাপত্তা
মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩



---

: মো. শামীম আলম খান :

‘আপনার সমস্যা বলুন, কতদিন যাবৎ? এর আগে কাউকে দেখিয়েছেন? কী কী ওষুধ খাচ্ছেন? কেনই বা ভালো হচ্ছেন না?’ এ কথাগুলো একজন রোগীকে চিকিৎসকের কাছ থেকে সবসময় শুনতে হয়। এক্ষেত্রে রোগীর চিকিৎসার ব্যাপার বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু রোগীর সেফটি অর্থাৎ নিরাপত্তার ব্যাপারটা অনেক সময় অগোচরে রয়ে যায়। ফলে রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকে। সময়ের প্রয়োজনে এখন একটি বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে-রোগীর নিরাপত্তার স্বার্থে রোগীকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং রোগীর কণ্ঠ আরও সোচ্চার হতে হবে।

১৭ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস। বিশ্বের সব রোগীর সেফটি বা নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের দেশসহ সব দেশ এবং আন্তর্জাতিক বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলো একক ও সামগ্রিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৭২তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সমাবেশে ‘গ্লোবাল অ্যাকশন অন পেশেন্ট সেফটি’ তথা রোগীর সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী পদক্ষেপ কর্মসূচি গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে ১৭ সেপ্টেম্বরকে বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবস হিসাবে ঘোষণা করে। রোগীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে এবং সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষার লক্ষ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, সবাইকে সম্পৃক্ত করা, সারা বিশ্ব যেন একই মনোভাব নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে রোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে-এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়।

এ বছর বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল-‘এনগেজিং পেশেন্ট ফর পেশেন্ট সেফটি’ অর্থাৎ রোগীর স¤পৃক্ততাই রোগীর নিরাপত্তা। একই সঙ্গে ‘এলিভেটেট দ্য ভয়েস অব পেশেন্ট ফর পেশেন্ট সেফটি’ তথা রোগীর নিরাপত্তায় রোগীর কণ্ঠ সোচ্চার হোক-এ শ্লোগান নিয়ে বিভিন্ন পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার, সেমিনার, সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের জন্য সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান চলেছে। তথ্য-উপাত্ত বলছে, প্রাথমিক ও বহিঃবিভাগ স্বাস্থ্যসেবায় প্রতি ১০ জনে ৪ জন অর্থাৎ ৪০ শতাংশ রোগী কোনো না কোনোভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এমনকি অনিরাপত্তাজনিত সেবার কারণে প্রতি মিনিটে পাঁচজন করে মারা যাচ্ছে।

এবার আসা যাক পেশেন্ট সেফটি বা রোগীর নিরাপত্তা বলতে কী বোঝায় এবং বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবসের মূল উদ্দেশ্য কী-এ প্রসঙ্গে। প্রথমে রোগীর নিরাপত্তা। একজন মানুষ যখন রোগাক্রান্ত হন, তখন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় রোগী একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক রোগীর শারীরিক অবস্থা ও ল্যাবসংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগের কারণ নির্ণয় করেন এবং যথারীতি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। সেই সঙ্গে নিয়মিত ওষুধ সেবনের উপদেশ দিয়ে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে রোগের ধরন ও তীব্রতা অনুসারে চিকিৎসক ছাড়াও নার্স, রোগীর নিকটাত্মীয়, রোগীর রক্ষণাবেক্ষক, হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ব্যবস্থাপকসহ স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত সবাইকে রোগীর বিষয়ে অবহিত করেন এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু তার পরও আমরা দেখেছি, সবার আন্তরিক চেষ্টা সত্ত্বেও কোথাও না কোথাও অবহেলা রোগীর জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি মৃত্যুরও কারণ হয়ে থাকে। তাই পেশেন্ট সেফটি বা রোগীর নিরাপত্তাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে : প্রতিরোধযোগ্য এমন সম্ভাব্য ক্ষতিগুলো যাতে রোগীদের না হয় অর্থাৎ অনুপস্থিত থাকে এবং রোগীকে চিকিৎসা স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় ক্ষতিকর ঝুঁকিগুলো যাতে সর্বনি¤œ স্তরে আনা হয়।

শুধু অনুন্নত দেশে নয়, উন্নত দেশগুলোতেও কখনো কখনো স্বাস্থ্যসেবার কোনো স্তরে অবহেলার কারণে রোগীর স্বাস্থ্যসেবা বিঘিœত হয় এবং রোগী ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রোগী যখন স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, সেবিকা, ফার্মাসিস্ট ছাড়াও আত্মীয়স্বজনের বা পরিবারের সদস্যের সঙ্গে নিজেও নিজের যতেœ অংশীদার হয়, তখন রোগীর সেফটি বা নিরাপত্তাসহ তার সন্তুষ্টি, এমনকি আরোগ্য লাভেও উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়। তাই এবার বিশ্ব রোগী নিরাপত্তা দিবসে রোগীর নিরাপত্তার স্বার্থে রোগীকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হচ্ছে।

রোগী যদি তার রোগ, নির্ধারিত চিকিৎসা, ওষুধ, ওষুধের মাত্রা, ওষুধের সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স¤পর্কে অবগত থাকেন এবং নিজে ও নিজের পরিবারের সদস্যরা, যারা রোগীর সেবায় নিয়োজিত আছেন-সবাই যদি নিয়ম মেনে চলেন, তবেই সম্ভাব্য চিকিৎসা ত্রুটি বা মেডিকেশন এরোর হওয়ার ঝুঁকি কমবে। সেই সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, ইনফেকশনজনিত সার্জারি, সেপসিস, শারীরিক ও মানসিক প্রেসার ইনজুরি, বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন-ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ক্রনিক কিডনি রোগ ইত্যাদি হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে। রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রা ও সেবনবিধি সঠিকভাবে মানতে হবে। যে মাত্রায় যত দিন খেতে বলা হয়েছে, তত দিনের কোর্স অবশ্যই পূরণ করতে হবে। উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ সেবনে বিশেষ নজর দিতে হবে, যাতে প্রতিদিনের মাত্রা বাদ পড়ে না যায়। যে কোনো ওষুধ গ্রহণের পর যদি অনাকাক্সিক্ষত কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তাহলে অবশ্যই নিয়োজিত স্বাস্থ্যসেবা সদস্য, চিকিৎসক, নার্স, সম্ভব হলে ফার্মেসিতে-যেখান থেকে ওষুধ কিনেছেন সেখানেও বিষয়টি অবহিত করতে হবে। রোগীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় তার এ কর্মকা- তারসহ সব রোগীর নিরাপত্তায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

পরিশেষে, একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, রোগী যদি তার স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়ে সবসময় সজাগ থাকেন, তাহলে তার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেযোগ্য ফল পাওয়া যায়। প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, রোগীর নিজেকে সম্পৃক্ত করার কারণে তার সম্ভাব্য ক্ষতি ১৫ শতাংশ কমে গেছে, কমেছে চিকিৎসা ত্রুটি, ফলে অনেক জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। আর তাই বলা হচ্ছে, রোগী ও রোগীর পরিবার যদি রোগীর স্বাস্থ্য রক্ষাসংক্রান্ত এবং রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে সজাগ থাকেন, তবেই রোগীর নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে।

মো. শামীম আলম খান : ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মাসিস্ট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক কনসালটেন্ট

বাংলাদেশ সময়: ১২:১৮:৫৯   ১৮৭ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

মুক্তমঞ্চ’র আরও খবর


ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতি
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে
আমার দেখা নিউইয়র্ক শহর
মুদ্রাস্ফীতিতে বাংলাদেশ
রোগীর সম্পৃক্ততাই তার নিরাপত্তা
বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের প্রেরণা
বেদনায় ভরা দিন
অর্থনীতিতে নার্সারিশিল্প
এলসি, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও উত্তরণ
উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অপর নাম আওয়ামী লীগ



আর্কাইভ