ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতি

প্রচ্ছদ » ভোলা সদর » ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতি
শুক্রবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩



---

।। ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা ।।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মধ্যে গঠন করা হয় স্বাধীনতার প্রস্তুতির নিউক্লিয়াস গ্রুপ। কেন্দ্রের সেই গ্রুপের সাথে প্রথমে যোগাযোগ করেন পরবর্তীতে জাসদ নেতা অ্যাডভোকেট একেএম নাসির উদ্দিন। পরে আমার সাথে যোগাযোগ তৈরি হয়। আমি ১৯৬৮ সালে ছাত্রলীগ ভোলা মহকুমা শাখার সাংগঠনিক স¤পাদক নির্বাচিত হই। সে সময় থেকে স্বাধীনতার মন্ত্রে কর্মীবাহিনী তৈরি করার লক্ষ্যে কালিনাথ রায়ের বাজারে আমার পড়ার ঘরে গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। একটু বলে রাখি, আমি যে ঘরটিতে বসে পড়াশোনা করতাম সেখানে আমাদের পারিবারিক রেস্ট হাউস ছিল। সেই রেস্টহাউসে একসময় থেকেছেন মরহুম মওলানা ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মাওলানা তর্কবাগীশ, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

আমাদের গোপন বৈঠক ঐ ঐতিহাসিক ঘরে বসে হতো। বৈঠকে আলোচনায় মূল নেতা ছিলেন এডভোকেট নাসির উদ্দিন আহমেদ। উপস্থিত থাকতেন অন্যান্যদের মধ্যে শহীদ সালেহ আহমদ, প্রাক্তন সভাপতি ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ কলেজ শাখার প্রাক্তন সাধারণ স¤পাদক বাবু কার্তিক দেবনাথ, ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল লতিফ ও জামাল উদ্দিন মাহমুদ প্রমুখ।

যতটুকু মনে পড়ে ভোলা কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি মরহুম কবি আমিনুল হক আনোয়ারের সম্পাদনায় ১৯৬৮ সালে একুশে ফেব্রুয়ারীতে “মুক্তির ডাক” নামে একটি সংকলন বের করা হয়েছিল। রহমানিয়া প্রিন্টিং প্রেসে সংকলনটি ছাপা হয়েছিল। মুক্তির ডাক নামটি আমি দিয়েছিলাম। সেই সংকলনে স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে সকলকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। আমরা অনেকদিন ভয়ে ভয়ে ছিলাম কখন দেশদ্রোহিতার মামলায় না জড়িয়ে পড়ি। ১৯৬৯ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে মরহুম সালে আহমদ ভাই সভাপতি ও আমি সাধারণ স¤পাদক নির্বাচিত হই। আমাদের নেতৃত্বে ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলন ভোলায় ব্যাপক রূপ লাভ করে। পুলিশি হামলা ও মামলার ভয়ে আমাদেরকে পালিয়ে থাকতে হয়েছে অনেকদিন।

অবশেষে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পতনের মধ্য দিয়ে সামরিক আইন জারি, জেনারেল ইয়াহিয়া কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণ, কিছুদিনের জন্য হলেও গা ঢাকা দিয়ে থাকা, ‘৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ভোলায় সাতটি উপজেলায় জননেতা তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে জনসভা। উক্ত জনসভাগুলোতে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের সুযোগ্য সন্তান ফাইজুল হক, আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী ও গুলিতে আহত সার্জেন্ট ফজলুল হকসহ আরো অনেক নেতা অংশগ্রহণ করেছিলেন। সারা দেশের ন্যায় ভোলাতেও ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে ছয় দফার পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে। সত্তরের নির্বাচনে ভোলা সদর জাতীয় সংসদ ভোলা-১ আসনে জননেতা তোফায়েল আহমেদ, জাতীয় সংসদ ভোলা-২ আসনে ডাক্তার আজহার উদ্দিন আহমেদ, প্রাদেশিক পরিষদ ভোলা-১ আসনে মোশারেফ হোসেন শাজাহান, প্রাদেশিক পরিষদ ভোলা-২ আসনে নজরুল ইসলাম, প্রাদেশিক পরিষদ ভোলা-৩ আসনে জনাব রেজাউল করিম চৌধুরী চুন্নু মিয়া, প্রাদেশিক পরিষদ ভোলা-৪ আসনে জনাব মোতাহার উদ্দিন মাস্টার সাহেব বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। এই জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ১৬৯ জাতীয় সংসদ আসনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে সমগ্র পাকিস্তানের একক দল হিসেবে স্বীকৃত হয়। এই জয়ের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধু তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য স্থির হয়ে ওঠেন। নির্বাচন-পূর্ববর্তী ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা শেষে একযোগে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে বঙ্গবন্ধু তাঁর অভিপ্রায় ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া পহেলা মার্চ পূর্বঘোষিত ৩ মার্চের জাতীয় সংসদ অধিবেশন বেতার ভাষণের মাধ্যমে স্থগিত করে দিলেন বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা না করে। তার ভাষণের সাথে সাথে সারা বাংলাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে। এর থেকেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শুরু। পহেলা মার্চ ইয়াহিয়ার ভাষণের সাথে সাথে আমি কলেজ থেকে ছাত্রদেরকে বের করে নিয়ে কলেজ সম্মুখে শহীদ মিনারে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য শপথ পড়ালাম। সেখান থেকে মিছিল করে শহরে এসে বিক্ষোভ জানালাম, প্রতিবাদ সভা করলাম। পরের দিন দোসরা মার্চ দোসরা মার্চ সারা ভোলায় প্রতিবাদ সমাবেশ আহ্বান করলাম। বরিশাল দালানের সামনে নিজ হাতে আমি আজকের পতাকার আদলে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। পরে পতাকা মিছিল নিয়ে ভোলা মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে এসে পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে জাতীয় সংগীত হিসেবে, আমার সোনার বাংলা, গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। বিশেষ দ্রষ্টব্য এসডিও অফিসের অনতিদূরে ভোলা ক্লাবে তখন পাকিস্তান আর্মির বেলুচ রেজিমেন্টের আস্তানা ছিল। তারা মেশিনগান তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল। মূলত তারা ভোলায় ৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের রিলিফ ওয়ার্কে এসেছিল। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাংলায় স্কুল মাঠে জড়ো করা হয়। সেখানে বসেই গেরিলাযুদ্ধ ও সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ছাত্র ব্রিগেড গঠন করা হয়। ছাত্রলীগের জয়বাংলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য ছুটিতে থাকা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহী আলী হোসেনকে মনোনীত করা হয়। পরে ল্যান্সনায়েক আব্দুর রব যোগদান করেন। টাউন ইস্কুলের মাঠে প্রথম ট্রেনিং শুরু হয়। অন্যদিকে ছাত্রলীগ সভাপতি আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগ সাধারণ স¤পাদক হিসেবে আমাকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা চলতে থাকে। কেন্দ্রের নির্দেশ মোতাবেক অসহযোগ আন্দোলন সফল করার জন্য আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম চলতে থাকে।

অন্যদিকে ছাত্র ব্রিগেডের সামরিক প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য আমরা ভোলা কলেজের ইউটিসি রাইফেল সংগ্রহ করি। এছাড়া প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে গেরিলা যুদ্ধের জন্য ভোলা কলেজের রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরী থেকে ছাত্রলীগ নেতা আজিজ ভূঁইয়াকে দিয়ে বোমা তৈরির কেমিক্যাল সংগ্রহ করি। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথম বার হাসপাতালের দেয়ালে বোমার পরীক্ষা চালানো হয়। কিন্তু কৃতকার্য হতে পারিনি। দ্বিতীয়বার জনাব আজিজ ভূঁইয়ার প্রচেষ্টায় সফল হই। কলেজ থেকে সংগ্রহ করা কেমিক্যাল দিয়ে আমরা বেশ কিছু বোমা বানিয়ে মওজুদ করি। এই কাজগুলো সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগেই আমরা সম্পন্ন করি। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পর স্বাধীনতার লক্ষ্যে আমাদের লক্ষ্য ¯পষ্ট হয়ে যায়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে জনমত গড়ে তোলার জন্য সভা-সমাবেশ-মিছিল অব্যাহত থাকে। সামরিক জান্তা বেতারে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করতে দেয় নি। আমাদের বেতার কর্মীদের অনমনীয়তা ও দৃঢ়তার কারণে পরের দিন বেতারে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে দেশবাসী আরো উজ্জীবিত হয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে আমরা আমাদের ট্রেনিং অব্যাহত রাখি। ২৫ মার্চ এর কাল রাত্রি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নারকীয় হত্যালীলা, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক রাত বারোটার পরে সরাসরি গোপন বেতার ও টেলিভিশনে, একটার দিকে ভোলা টি এন্ড টি এর অপারেটর এলাহী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার টেলিগ্রাম বার্তাটি আমাদের বাসায় পৌঁছে দেন। টেলিগ্রাম মেসেজটি পাওয়ার পরপরই আমার বড় ভাই সাবেক তথ্য কমিশনার মরহুম মোঃ ফারুক মোল্লা ও ওবায়দুল হক বাবুল মোল্লাসহ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের জিপে মাইক লাগিয়ে সারারাত শহরে প্রচারে নেমে পড়ি। সাথে সাথে জনগণ রাস্তায় নেমে গভীর রাতে মিছিল শুরু করে দেয়। ¯ে¬াগানে মুখরিত হয়। জয়বাংলা, তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো। সংগ্রাম পরিষদ থেকে জানিয়ে দেয়া হয় ছুটিতে থাকা সকল বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদেরকে বিকেলে নতুন বাজার টাউন হল সংলগ্ন টেনিস মাঠে সমবেত হওয়ার জন্য। সেখানে প্রচুর সংখ্যক আর্মি ইপিআর পুলিশ ও ছুটিতে থাকা পুলিশের সদস্য উপস্থিত হয়। তাদেরকে নিয়েই প্রথম গঠন করা হয় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা দল। নেতৃত্ব প্রদান করা হয় সুবেদার মান্নানকে। এই দলটির একটি গ্রুপকে বরিশাল থেকে অস্থায়ী সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বরিশাল পাঠানো হয় ক্যাপ্টেন বেগের অধীনে। সেখান থেকে তাদেরকে পাঠানো হয় খুলনা খালিসপুর গল্লামারী বেতার কেন্দ্র দখল করার জন্য।

বাকি সদস্যদের নিয়ে ভোলায় প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। ২৪ শে মার্চ থেকে কালিনাথ রায় বাজারস্থ মোল্লা বাড়ির উঠানে মেয়েদের ট্রেনিং ক্যা¤প প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে মেয়েদেরকে সামরিক ট্রেনিংসহ ফার্স্ট এইড ট্রেনিং প্রদান করা হয়। মেয়েদের সামরিক ট্রেনিং প্রদান করেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার ভোলা কলেজ ইউডিসি ট্রেনার হাবিলদার চান মিয়া। মুক্তিযুদ্ধে ভোলা প্রস্তুতিপর্ব এভাবে শুরু হয়।

লেখকঃ ফজলুল কাদের মজনু মোল্লা

সভাপতি, ভোলা জেলা আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশ সময়: ২২:০৫:৪৯   ১৫০ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

ভোলা সদর’র আরও খবর


ভোলায় ছাত্রলীগের বৃক্ষরোপন কর্মসূচি পালিত
সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোলায় সমাবেশ
ভোলায় ৬ দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর সরকারি চাকরিজীবী ফোরামের স্মারকলিপি
ভোলায় শিক্ষা বিষয়ক গ্লোবাল অ্যাকশন সপ্তাহ পালিত
ভোলায় দিনমজুরদের শীতল পানি ও স্যালাইন বিতরণ করল ইসলামী ছাত্র আন্দোলন
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্দেশে ভোলায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন
ভোলায় তীব্র তাপদাহে অস্থির জনজীবন
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: ভোলায় তিন উপজেলার ৩৮ প্রার্থীর সকলের মনোনয়নপত্র বৈধ
ভোলায় কৈশোর বান্ধব স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত
কেউ গুজবে কান দিবেননা ভোটারদের উদ্দেশ্যে: চেয়ারম্যান প্রার্থী মোঃ ইউনুছ



আর্কাইভ