॥ এম জি নিয়োগী ॥
পারভীন আক্তার। বয়স ৩৭। উপকূলের প্রত্যন্ত অঞ্চল গোলবুনিয়ার মেয়ে। গোলবুনিয়া গ্রামটি বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলার আঠারোগাছিয়া ইউনিয়নে। উপকূলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ি হওয়া সত্ত্বেও পারভীনের লেখাপড়ার প্রতি ছিল অদম্য উৎসাহ। সেই অদম্য উৎসাহেই আর্থিক অনটনের মধ্যেও ২০০১ সনে টুঙ্গিবাড়ীয়া স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। এরপর পড়াশুনা আর এগিয়ে নিতে পারেননি। বিয়ে হয়ে যায় মিজানুর রহমানের সঙ্গে।
মিজানুর রহমান পোড় খাওয়া এক পরিশ্রমী যুবক। পটুয়াখালী সদরের বসাক বাজারে ভাড়া নিয়ে একটি ধান ভাঙানো মিল বসিয়েছেন। সঙ্গে চাল গুঁড়া করাসহ সরিষা ভাঙানোর মেশিনও বসিয়েছেন। অভাব-অনটনের মধ্যেও সংসার চলছিল। এরই মধ্যে যোগ হলো এক ছেলে আর এক মেয়ে। পারভীন এসএসসি পাস করার পর আর পড়তে না পারলেও ছেলেমেয়েকে অনেকদূর পর্যন্ত পড়াবেন এটাই ছিল তার স্বপ্ন।
সেই স্বপ্নকে সামনে রেখেই ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করালেন; কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটতে না হাঁটতেই হঠাৎ করেই সংসারে নেমে এলো কালো অন্ধকার। স্বামী মিজানুর রহমান হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একেবারে চলৎশক্তিহীন। চিকিৎসায় কোনো কাজ হচ্ছিল না। যে ধান ভাঙানো মিল ছিল সংসারের আয়ের একমাত্র উৎস সেটি বন্ধ হয়ে গেল। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ হওয়ার পথে। দুবেলা খাওয়ার জোগাড়ই তো সম্ভব হচ্ছে না; কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হন পারভীন। পারভীন বুঝতে পারলেন এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাকেই এখন সংসারের হাল ধরতে হবে। যে ধান ভাঙানো মিল ছিল তাদের একমাত্র উৎস সেটি আবার ঝেড়ে-মুছে খোলা হলো। আত্মীয়স্বজন তাদের প্রত্রিক্রিয়ায় বললেন- মিল চালানো তো শারীরিক সামর্থ্যরেও ব্যাপার! তাছাড়া লোকজন আত্মীয়স্বজন এরাই বা কি বলবে! পারভীন ¯পষ্ট তার প্রতিক্রিয়ায় জানালেন- আমার তো খেতে হবে! স্বামীকে চিকিৎসা করাতে হবে! ছেলেমেয়েকে পড়াতে হবে! এছাড়া আর কোন উপায় তো দেখছি না! আপনাদের কি কোন উপায় জানা আছে! স্বামীর চিকিৎসার পাশাপাশি পারভীন পুরোপুরি মিল ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করলেন।
শুনেছিলেন অস্ট্রেলিয়া সরকারের প্রকল্প থেকে মুগডাল ভাঙানো মেশিন পরীক্ষামূলকভাবে মুগডাল উৎপাদিত এলাকায় বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। পারভীন সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করলেন আমতলীর পোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রাম নামক সংস্থার সঙ্গে। দেখা করলেন সংস্থার মামুন এবং শহিদুল সাহেবের সঙ্গে। একদিন অফিস থেকে পারভীনের মিলটি সরেজমিন দেখা হলো।
এলাকাটি মুগডাল উৎপাদিত এলাকা হওয়ায় এবং মিলটি বাজারের আকর্ষণীয় স্থানে হওয়াতে অস্ট্রেলিয়ার এই প্রকল্প স¤পূর্ণ বিনামূল্যে পারভীনকে মুগডাল ভাঙানো মেশিনটি দেয়। ওই এলাকায় এ মেশিনটি একমাত্র মুগডাল ভাঙানো মেশিন হওয়ায় মুগডাল কৃষকদের কাছে এই মিলের চাহিদা এখন আকাশচুম্বী।
পারভীন তার সততা দিয়ে ব্যবসা কার্যক্রম চালানোর কারণে এলাকাবাসী তার প্রতি এখন সহানুভূতিশীল। তার ব্যবহারের কারণে তার মিলে এলাকার লোকজন মুগডালসহ অন্যান্য পণ্য ভাঙাতে আসেন। পারভীনের আন্তরিকতায় তার স্বামী এখন অনেকটাই সুস্থ। তার ছেলেমেয়ে আবার স্কুলে যাচ্ছে। পারভীন স্বামী-সন্তান নিয়ে মিল সংলগ্ন এলাকাতেই থাকছেন। যদিও তার স্বামী এখন সুস্থ, তবুও মিলের কার্যক্রম পারভীনই দেখাশোনা করেন। আরো বেশি আয়ের জন্য মিলের সামনে পারভীন একটি মুদির দোকান দিয়েছেন। সেখান থেকেও তার আয় আসছে। সে আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখছে- তার ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষিত হবে! সমাজের সেবা করবে! দেশের উন্নতি করবে।
যে পাড়া-প্রতিবেশীরা একসময় পারভীন মেয়ে হয়ে মিল চালাবে বলে টিপ্পনি কাটছিল, খারাপ চোখে দেখছিল তারাই এখন পারভীনকে বাহবা দিচ্ছেন। সেদিনের পারভীনের সেই সাহসী সিদ্ধান্তেই আজকে একটি পরিবার ঝরেপড়ার হাত থেকে রক্ষা পেল। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারল।
[লেখক: স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২১ প্রাপ্ত বিজ্ঞানী, ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া]
বাংলাদেশ সময়: ১৮:৩০:৩৮ ১৫৫ বার পঠিত