রিজার্ভ, বিদ্যুৎ ও ব্যয় নির্বাহের প্রশ্ন

প্রচ্ছদ » অর্থনীতি » রিজার্ভ, বিদ্যুৎ ও ব্যয় নির্বাহের প্রশ্ন
সোমবার, ১৯ জুন ২০২৩



---

॥ হাসান মামুন ॥

সরকার এমনভাবে বাজেটটি পেশ করেছে যে, অর্থনীতিতে যেন তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। অথচ প্রায় প্রতিদিনের খবর বলে দেয়, অর্থনীতি সংকটে আছে। এ নিবন্ধ লেখার দিন খবর রয়েছে, এডিবি ও এআইআইবি থেকে সরকার মোট ৮০০ মিলিয়ন ডলার ‘বাজেট সহায়তা’ নিচ্ছে। এ সময় দ্রুত এ ঋণ হাতে এলে সেটা হবে কিছুটা স্বস্তির। এতে সুদের হার কম এবং গ্রেস পিরিয়ড মিলবে ভালোই।

একে ‘সফট লোন’ বলা যেতে পারে। এটা রিজার্ভ পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উন্নত করবে। এক বছরেই রিজার্ভ কোত্থেকে কোথায় নেমে এসেছে, সেটা তো জানা। আইএমএফ’র হিসাবায়ন পদ্ধতি মেনে রিজার্ভের খবর দিলে এটা অবশ্য আরও কম হবে। সরকার তার হাতে থাকা রিজার্ভ এখনো দেখাচ্ছে না কেন, সেটা বোধগম্য নয়। যা হোক, রিজার্ভ কম মানে আমদানি সক্ষমতা কম। আমদানিনির্ভর একটি অর্থনীতির জন্য এটা বিপজ্জনক। শ্রীলংকার পর এ অঞ্চলে পাকিস্তান বিপদে আছে আমদানি সক্ষমতা অনেক কমে যাওয়ায়। আমাদের অবস্থা সে তুলনায় এখনো ভালো। পাকিস্তানের মতো আমরা বিদেশি ঋণ না পাওয়ার সংকটে নেই। সামনে আইএমএফ’র ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার কথা। সেজন্য তাদের কিছু শর্ত পরিপালনের মধ্যে আমরা আছি। এরই মধ্যে বাজেটও তৈরি করতে হয়েছে এবং তাতে ঘটাতে হয়েছে ওইসব শর্তের কিছু প্রতিফলন। যেমন, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর প্রয়াস রয়েছে। সঞ্চয়পত্র থেকে কম অর্থ আহরণের পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গিও নজর কাড়ে। এগুলো আমাদের বাস্তবতাও। আইএমএফ তো অবাস্তব কিছু বলেনি। তার সংস্কারের পরামর্শগুলো আমাদের অর্থনীতির অন্তর্গত চাহিদার সঙ্গে একেবারে বেমানান নয়।

কথা হচ্ছিল রিজার্ভ নিয়ে। আইএমএফ তার ঋণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখার জন্য রিজার্ভকে একটা পর্যায়ে রাখতে বলেছে। সরকার নিজে থেকেও এটা চাইছে মনে হয়। রিজার্ভ অব্যাহতভাবে ক্ষয়ে যাওয়াটা তারও দুশ্চিন্তার কারণ। সরকার দেখছে, জরুরি পণ্যসামগ্রী আমদানি করতে গিয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। এমনকি বকেয়া বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না বলে ওইসব উৎস থেকে নতুন করে পণ্য আনা যাচ্ছে না। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে এ সংকট প্রতিফলিত হচ্ছে সবচেয়ে গভীরভাবে। সরকারের হাতে সত্যি বলতে যথেষ্ট দেশীয় মুদ্রাও নেই। সে কারণে বিদ্যুৎ কেনা বাবদ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধও সময়মতো করা যাচ্ছে না। ভাড়ায়চালিত কিছু কেন্দ্রের বিদ্যুৎ আবার কেনা হয় সরাসরি ডলারে। তাদের বিল পরিশোধ স্বভাবতই আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। এ নিবন্ধ লেখার সময়টায় অবশ্য আছে কয়লা ও ফার্নেস অয়েল নিয়ে কয়েকটি জাহাজ আসতে থাকার খবর। এ খবরও রয়েছে-অব্যাহতভাবে এসব জ্বালানি এনে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই সরকার। মহেশখালীতে আরও একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বসানোর খবর এর মধ্যে অবশ্য আশা জাগায়। কাজটি স¤পন্ন হলে বিভিন্ন খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে। কিন্তু এতে করে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের আমদানিনির্ভরতা কি আরও বাড়বে না? এটা কমানোর কথাই তো হচ্ছিল। সেটা কিন্তু হয়নি। এদিকে আমরা অব্যাহতভাবে আরও বড় বাজেট দিয়ে যেভাবে হোক-বাস্তবায়ন করে চলেছি। কিন্তু গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ¯পষ্ট ও টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারিনি। এদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ‘ক্যাপাসিটি’ বাড়াতে বছরের পর বছর বিপুল অর্থ বিনিয়োজিত হয়েছে। এজন্য দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ এবং তার ‘বেপরোয়া ব্যবহার’ হয়েছে বললে ভুল হবে না। এর বোঝা বহুদিন বইতে হবে নীতিনির্ধারকদের নয়-জনগণকে। প্রতি বাজেটে বাড়াতে হবে ঋণ ও এর সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ।

এরই মধ্যে কয়েকগুণ বেশি দাম দিতে প্রস্তুত থাকলেও জনগণ কিন্তু পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। শিল্প খাতও জ্বালানি সংকটে ভুগছে, এমনকি রপ্তানিমুখী শিল্প। নিজস্ব প্লান্টে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তাদের হারাতে হচ্ছে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা। দেশীয় বাজারে তাদের বেড়ে ওঠা উৎপাদন ব্যয়ের চাপ গিয়ে পড়ছে ভোক্তার ঘাড়ে। এ ভোক্তাকে একটা উচ্চ মূল্যস্ফীতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে অনেকদিন ধরে। বিদায়ী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার যে সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন অর্থমন্ত্রী, তা মোটেও রক্ষা করা যায়নি। নতুন বাজেটে এটা কমিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করা হয়েছে নতুন করে। কিন্তু সেটা কীভাবে, তার বিশ্বাসযোগ্য নির্দেশনা নেই। অর্থমন্ত্রীও বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে তারা শঙ্কিত।

এত শঙ্কার তো কিছু নেই। প্রতিবেশী দেশ ভারতও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে এর মধ্যে। আমেরিকা অনেক দূরের দেশ। তার মূল্যস্ফীতিও কমে এসেছে অনেক এবং আমাদের জন্য সেটা হতে পারে সুখবর। কেননা এতে করে তার পোশাকপণ্যের চাহিদা বাড়লে এখান থেকে রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ ঘটবে। আমেরিকার বাজারে পোশাকপণ্যের চাহিদা তো মাঝে কমে গিয়েছিল। তাতে সেখানে আমাদের রপ্তানিও কমে। আমেরিকা থেকে প্রবাসী আয় আসা অবশ্য বেড়ে গেছে এবং কিছুটা আশ্চর্যজনকভাবে সেটা সৌদি আরবকেও গেছে ছাড়িয়ে। এপ্রিল পর্যন্ত এমনটাই পরিস্থিতি। সিপিডির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানও মনে করছে, পাচারকৃত অর্থের একাংশ প্রবাসী আয় হয়ে দেশে আসছে। সেটা খাতাপত্রে এসে যাচ্ছে এবং সঙ্গে এর গ্রহীতারা আবার পাচ্ছেন প্রণোদনা। সে যা-ই হোক, এমন সংকটকালে বিদেশি মুদ্রার প্রবেশ যত বাড়ে, ততই মঙ্গল। সাম্প্রতিককালে আমাদের বড় শ্রমবাজারগুলোয় শ্রমিক প্রেরণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। সে অনুযায়ী ওইসব উৎস থেকে প্রবাসী আয় বাড়লে রিজার্ভ পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত হতে পারত। তখন সরকারও পারত স্বস্তির সঙ্গে আমদানি বিল নি®পত্তি, ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি করতে এবং প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক পারত আস্থার সঙ্গে বাজারে আরও ডলার ছাড়তে। তাতে বেসরকারি খাতেও চাহিদামতো পণ্যসামগ্রী আমদানি করে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা সহজ হতো। আমরা যত বড় বাজেটই দিই না কেন-বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কিন্তু বাড়ানো যাচ্ছে না বেশ কবছর ধরে। এর কারণ হিসাবে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের বেশি বেশি ঋণ গ্রহণকে দায়ী করা হচ্ছে। নতুন বাজেটেও রয়েছে ব্যাংক থেকে অধিক ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা। সরকার সঞ্চয়পত্র বেচে অর্থ সংগ্রহ করতে না পারলে, বিদেশ থেকে ঋণপ্রাপ্তি সহজ না হলে আর কী করতে পারে-ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ ছাড়া? তবে একটা কাজ সরকার করতে পারত। কম ব্যয় করা। কম অপচয় করা। উন্নয়নমূলক ব্যয় বেশি করে অনুন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে দেওয়া। কিন্তু সেটা চট করে করতে পারবে না কোনো সরকার। তাছাড়া জাতীয় নির্বাচনের বছরে ভিন্নভাবে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যাওয়া কঠিন। তাকে গতানুগতিক পথেই চলতে হবে এবং সেজন্য একটি প্রথাগত বাজেটই দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এটি তৈরি করেছেন প্রধানত আমলারা। দেশ পরিচালনায় গত দুই মেয়াদে তাদের ভূমিকাও অনেক বেড়ে উঠেছে। তবে তারা হয়তো অখুশি হবেন না সরকারি খাতে বেতন-ভাতা আপাতত না বাড়ালে। এর চেয়ে অনেক বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে যে বেসরকারি খাত-উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে তার লোকবলের অবস্থা তো সাধারণভাবে বেশি খারাপ। ওখানে বিনিয়োগ না বাড়ায় একদিকে নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না; অন্যদিকে ছাঁটাই চলছে। দীর্ঘ করোনার অভিঘাতের পর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও মোকাবিলা করতে হচ্ছে খাতটিকে। আর অনানুষ্ঠানিক খাতে যারা নিয়োজিত-তারা আছে শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে শহর, এক শহর থেকে আরেক শহর এবং বিদেশে চলে গিয়ে আত্মরক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নের সংগ্রামে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিবিএসের জরিপ রিপোর্টটি মনোযোগ কাড়বে।

এ অবস্থায় সরকারকে প্রথমত চেষ্টা করতে হবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত সচল রাখার, যাতে দেশজুড়ে গ্রাহকরা বিদ্যুৎ পায় এবং শিল্প খাতও না ভোগে। শিল্পের আরেক বড় সমস্যা হলো দেশের ভেতর বেড়ে চলা পরিবহন ব্যয়। এটা কমাতে সরকারের সামনে সুযোগ রয়েছে বিশেষত ডিজেলের দাম কমানোর। বিশ্ববাজারে এর দাম এখন নিুমুখী। ডিজেলের দাম কমানো গেলে কৃষি উৎপাদন ব্যয় এবং কৃষিপণ্যের দামেও এর প্রভাব পড়বে। দেশে মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য অর্জনে সেটা হবে সহায়ক। আর সরকারকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে বেশি করে নমনীয় বিদেশি ঋণ গ্রহণের। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সঙ্গে স¤পর্কের অবনতি ঘটতে দেওয়া যাবে না। এখনো এলডিসিভুক্ত হিসাবে বেশি করে অনুদান লাভের চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে বাজেট বাস্তবায়নে কর-রাজস্ব আদায়ে ইতোমধ্যে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে বেশি করে চেপে ধরতে হবে না। করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়িয়ে সরকার আবার ‘ন্যূনতম কর’ আদায়ের প্রস্তাব করছে কেন, তা কিন্তু বোধগম্য হয়নি। এটা যত দ্রুত প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়, ততই মঙ্গল। এমন ভাব করা তো ঠিক নয় যে, শূন্য আয়কর দেওয়া মানুষজন অন্যান্য পণ্য আর সেবা কিনতে গিয়েও কোনো কর দেয় না। সত্যি বলতে, তাদের দেওয়া কর-রাজস্বেই চলছে দেশটা। হচ্ছে অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকা বাজেটের প্রশ্নবিদ্ধ বাস্তবায়ন। ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলছি এ কারণে, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে উন্নয়ন বাজেটের ৫০ শতাংশও ব্যয় হয়নি। এ অবস্থায় বাকি ২ মাসে বাস্তবায়নের নামে যা হচ্ছে, তার অনেকটাই অপচয়মূলক ব্যয়। এ নিয়ে আলাদা করেই লেখা যেতে পারে একখানা নিবন্ধ। কিন্তু লিখে কী হবে? বলেই বা কী! সরকার যা করার, তা-ই করবে। সংকটকাল হলেও বাজেটের আকার তো আর কমাবে না। তবে এটা ঠিক, এ বাজেট বাস্তবায়ন করতে হবে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সরকারকেও। সেক্ষেত্রে সরকারে ধারাবাহিকতা থাকলেও ডিসেম্বরের দিকে এর একটা ‘অর্ধবার্ষিক পর্যালোচনা’ করা উচিত হবে। ততদিনে সরকারের অর্থ আহরণ ও ব্যয় নির্বাহে সংকট আরও বেড়ে না উঠলেই খুশি হব।

হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৩১:২৬   ১৬৯ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

অর্থনীতি’র আরও খবর


মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় বাগদার রেণু শিকারের মহোৎসব
ভোলায় লাজফার্মা মডেল ফার্মেসির উদ্বোধন
ভোলা মহাজনপট্টিতে স্বপ্ন আউটলেটের শাখা উদ্বোধন
লালমোহনে ১২৬ কোটি টাকার বোরো ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা
ভোলার গ্যাস উৎপাদন: কূপ খননে আরও চড়া দাম চায় গাজপ্রম
ভোলায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ২ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়ে ছাই
নদীতে মিলছে না কাংখিত ইলিশ, হতাশ জেলেরা
কাঁচের চুড়ি তৈরিতে ব্যস্ত বোরহানউদ্দিনের শ্রমিকরা
দুই মাসের নিষেধাজ্ঞার পর মাছ শিকারে প্রস্তুত জেলেরা
লালমোহনে তীব্র গরমে মুরগির খামারিদের বাড়ছে দুশ্চিন্তা



আর্কাইভ