আমজনতার আমের জন্য শোকগাথা

প্রচ্ছদ » মুক্তমঞ্চ » আমজনতার আমের জন্য শোকগাথা
রবিবার, ২৩ জুলাই ২০১৭



: মোফাজ্জল করিম :

এককালে আম ছিল আমজনতার, এখন নেই। কথাটা বললে কি ভুল হবে? আর আমজনতা বলতে আমি আমাদের এই ‘নিম্ন মধ্যম আয়ের’ দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের কথাই বলছি। মধ্যবিত্তরা যদিও কালেভদ্রে একদিন সাহস করে এক কেজি আম কিনে এনে ছেলেপুলেদের সংসারে আমানন্দের (আম + আনন্দ = আমানন্দ। আম দর্শন বা ভক্ষণে যে আনন্দ তাকে আমানন্দ বলা যেতে পারে। মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস হতে পারে কি? থাকগে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে বৈয়াকরণরা আবার অনধিকার চর্চা করছি বলে রেগে যেতে পারেন। ) হিল্লোল বইয়ে দেবার প্রয়াসী হলেও হতে পারেন, কিন্তু এক শ-দেড় শ টাকা, কমপক্ষে ৬০/৭০ টাকা, খরচ করে দেশের হতদরিদ্র শ্রমিক-মজুর-চাষাভুষা মানুষদের পক্ষে আম কেনা রীতিমত বিলাসিতা। কাজেই ধরে নেওয়া যায়, ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর, আ¤্রপালি এবং আরও অসংখ্য জাতের আমের নামই শোনেনি দেশের অগণিত গরিব মানুষ, যাদের দু’বেলা নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থায় দিন কাটে বারো মাস। কী আমের মৌসুমে, কী অন্য সময়ে। তাই আমের আবির্ভাব ঘটে কেবল উচ্চবিত্ত ও সচ্ছল পরিবারের মানুষদের রসনাতৃপ্তির জন্য, এ কথা বললে বোধ করি অতিশয়োক্তি হবে না। তবে হ্যাঁ, ব্যতিক্রম হচ্ছে, উন্নত জাত ও মানের প্রচুর আম উৎপাদনে যেসব অঞ্চলের প্রভূত সুনাম আছে সেই সব অঞ্চল। অর্থাৎ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলা। ওই সব জেলার ধনী-গরিব সবাই আমের সিজনে আঁশ মিটিয়ে আম খেতে পারেন। আর এমনিতে আম যেহেতু বাংলাদেশের সব জেলাতেই অল্পবিস্তর বিক্ষিপ্তভাবে জন্মায়, অতএব অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীরা সাধারণ মানের আম অপর্যাপ্ত পরিমাণে হলেও আমের মৌসুমে খেতে পান। সেখানেও ধনী-গরিবের ব্যাপার আছে। গ্রামে যাদের বাড়িতে দু’একটা আমগাছ আছে, সেই সব সৌভাগ্যবান এবং তাদের সন্তান-সন্ততিরা তৃপ্তির সঙ্গে নিজের গাছের আম খান। আর যাদের নিজেদের গাছ নেই, তারা রাস্তার ধারের বা মাঠে-ময়দানের বারোয়ারি গাছে-ঢিল মেরে অথবা সুযোগ পেলে গাছ থেকে পেড়ে খাওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের শৈশবে-কৈশোরে অন্যের গাছে ঢিল মেরে কাঁচা আম-পাকা আম পাড়তে গিয়ে বকুনি খাওয়ার একটা আলাদা মজা ছিল। তবে নৃশংসভাবে বৃক্ষনিধনের কারণে আজকাল বেওয়ারিশ গাছÑতা আমই হোক আর জাম-কাঁঠাল যা-ই হোকÑক্রমেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ফলে আমজনতার মাগনা আম খাওয়ার সুযোগও সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। সেদিক থেকে আমরা যারা শহরে বাস করি, তারা মোটামুটি ভাগ্যবান। রাজশাহী-চাঁপাই নওয়াবগঞ্জ ও অন্যান্য অঞ্চলের শত শত আমবাগানের আম মৌসুম শুরু হতে না হতেই রওনা দেয় ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট ও অন্যান্য শহরাঞ্চলের দিকে। আর শহরের সচ্ছল মানুষকে মফস্বলের লোকের মত রেস্ত নিয়ে ভাবতে হয় না, তারা বাজারে আমের শুভাগমন ঘটলেই একেবারে হামলে পড়ে। যেন কতদিন ধরে তারা হা-পিত্যেশ করছিল এই রসনা তৃপ্তিকারী ফলটির জন্য। আর এটাও ঠিক, আমাদের দেশে আমের মত আর কোনো ফল জনপ্রিয় না। (ভোটের সময় আম প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়ে কোনো প্রার্থী হারলেও হারতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশের ফলমূল যদি নিজেদের মধ্যে কে সবচেয়ে জনপ্রিয় তা যাচাই করার জন্য ভোটের আয়োজন করে, আর ভোটার যদি হয় ফল ভক্ষণকারী মানুষ, তা হলে আম শুধু জয়লাভই করবে না, অন্য প্রায় সব প্রতিদ্বন্দ্বীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। )
আম গ্রীষ্মকালীন ফল। বাজারে পাকা আম উঠতে শুরু করে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময় থেকে। এর আগে বৈশাখের শুরু থেকেই পাওয়া যায় কাঁচা আম। কাঁচা আমের আচারও কম জনপ্রিয় না। আর গরমের দিনে আমডাল না হলে তো ভোজনবিলাসীদের খাওয়া হয় না। (এর একটা গল্প আছে। হাতে সময় থাকলে পরে বলব। )
তা এত যে জনপ্রিয় আম, তার দিকেও ক্রেতাসাধারণ হঠাৎ সন্দেহের চোখে তাকাতে লাগল কিছুদিন আগে থেকে। বেশি দিন না, মাত্র এই কয়েক বছর হয় এমনটি হয়েছে। হঠাৎ চাউর হলো : সাবধান, আম খেয়ো না, ওতে বিষ মেশানো হচ্ছে আজকাল। কী বিষ? বিষের নাম ফরমালিন, যা মৃত মানুষের দেহে মাখিয়ে দিনের পর দিন শবদেহের পচন রোধ করা যায়। যা ওষুধ প্রস্তুতে ও অন্যান্য শিল্প-কারখানায়, বিজ্ঞানাগারে ব্যবহৃত হয়। বাঙালি হঠাৎ যেন জেগে উঠে দেখল, তাইতো, এই বস্তু ব্যবহার করলে ফলমূল-তরিতরকারি, মাছ ইত্যাদি দিনের পর দিন কৃত্রিমভাবে তরতাজা রাখা যায়। অতএব, শুরু হয়ে গেল ফরমালিনের অবাধ ব্যবহার। ভোজ্যপণ্য যাই কিনতে যাওয়া হোক না কেন, সন্দেহ জাগে ফরমালিন মিশ্রিত না তো? অথচ আশ্চর্য, কিছুদিন আগে পর্যন্ত ফরমালিনের নামও শোনেনি মানুষ। হ্যাঁ, খাদ্যে ভেজাল মেশানো তো চলে আসছে সেই আদ্যিকাল থেকে। আর সে কারণেই বোধ হয় আমাদের সময়ে স্কুলে ‘মিশ্রণের অঙ্ক’ বলে একটা অঙ্কই শেখানো হতো। এর প্রশ্নটা ছিল এ রকম : দশ সের দুধের সঙ্গে কত সের পানি মিশালে দুধ ও পানির অনুপাত হইবে ২ : ১। একে অনুপাতের অঙ্কও বলা হতো। (এক ছাত্র পরীক্ষায় এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে নাকি লিখেছিল দুধে পানি মেশানো অত্যন্ত অন্যায়। এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ আমি কখনোই করব না। তেমনি বার্ষিক শতকরা ৫ টাকা হার সুদে কত টাকা ১০ বছরে ২০ হাজার টাকা হবে? এরূপ প্রশ্নের জবাবে সেই ছেলের অবস্থান ছিল আরও শক্ত : ‘ইসলাম ধর্মে সুদ দেওয়া-নেওয়া নিষিদ্ধ। অতএব এ ধরনের প্রশ্ন করা ঠিক নয়। ’) কিন্তু ফরমালিন কী অনুপাতে মেশাতে হবে, তাতে আম-আপেল বা রুই মাছ-কাতলা মাছ কত দিন পর্যন্ত তাজা থাকবে, তাতে মাছি বসবে না, দুর্গন্ধ ছুটবে নাÑএ রকম চিন্তা তখন কারো মাথায় আসেনি। যখন জানা গেল, ফরমালিন মিশ্রিত দ্রব্য সেবা করে ক্যান্সার ও অন্যান্য প্রাণঘাতী অসুখবিসুখ হতে পারে, তখন পাবলিক গেল ভয় পেয়ে। কেনাবেচা লাটে ওঠার দশা। আর কর্তৃপক্ষ যথারীতি ঢাকঢোল বাজিয়ে ময়দানে নেমে গেল। কিন্তু ফলাফল যে শূন্য সেই শূন্য। কারণ কর্তৃপক্ষীয় নিয়মে এক্ষেত্রেও ভাষণ-তোষণ-শোষণ ও হম্বিতম্বি হলো যথেষ্ট, কাজ হলো না কিছুই। ফলে আমখোর-মাছখোর বাঙালি ফরমালিনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে এগুলো সাবড়াতে লাগল ঠিকই। আর তাদের শরীর হয়ে গেল ‘ফরমালিনপ্রুফ’। ভাবটা যেন : ‘হে তুচ্ছ ফরমালিন, তুমি মোরে কী দেখাও ভয়/ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়’।
মুশকিল হয়েছে, এসব ভেজালের প্রতিক্রিয়া তো আর তাৎক্ষণিক নয় যে চিকুনগুনিয়ার মত জ¦র, মাথা ব্যথা, গিরায়-গিরায় ব্যথা হবে, আর রোগী বিছানায় পড়ে মাগো-বাবাগো বলে চিৎকার দেবে। ক্যান্সার দেখা দেবে হয়ত এক যুগ দুই যুগ পরে, কিডনি বা লিভার ঝাঁঝরা হতে হতে মানুষটিকে ঠেলে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দুয়ারে। এত কিছু জানা সত্ত্বেও পাবলিক ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’Ñগান গাইতে গাইতে ফরমালিন মিশ্রিত সব ভোজ্য বস্তুই গলাধঃকরণ করছে।
তবে হ্যাঁ, জানি না আপনারা লক্ষ্য করেছেন কি না, এবার বাজারে ফরমালিনমুক্ত আমের সরবরাহ ছিল উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে সরকারি প্রচেষ্টা ও উৎপাদনকারীদের উদ্যোগ ছিল নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। দামও অন্যান্য বারের তুলনায় ছিল অপেক্ষাকৃত কম। দাম কমে যাওয়ার প্রধান কারণ বোধ হয় এবার আমের ফলন হয়েছিল বেশি।
তবুও আমের দাম গরিব ক্রেতাসাধারণের নাগালের ভেতর ছিল বলা যাবে না। এবং এর উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরিবহন ইত্যাদি খরচ বিবেচনা করলে এর চেয়ে সস্তায় বোধ হয় আম খাওয়া যাবে না। অবশ্য যারা এই মূল্য বা এর চেয়েও অধিক মূল্য দিতে সক্ষম, তাদের সংখ্যাও খুব কম নয়। তাদের চাহিদা (ডিম্যান্ড) ও সরবরাহকারীদের সরবরাহ (সাপ্লাই) দু’টো অর্থনীতির যে বিন্দুতে মিলে যায় (ইক্যুলিব্রিয়াম বা সমাবস্থা), তাতে দাম আর কমবে নাÑএটা ধরে নেওয়া যায়। অর্থাৎ যে আমজনতার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, আম তাদের নাগালের বাইরেই থেকে যাবে। কী আর করা। শুধু আম কেন, জাম-কাঁঠাল-কলা-আনারস কোন ফলটাই তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারে? রুই-কাতলা-ইলিশ-বোয়াল-কই-পাবদা কোন মাছটাই বা খেতে পায়? ধনী-গরিবের যে বৈষম্য সমাজ-কাঠামোয় আমরা করে রেখেছি, তাতে এটা এভাবেই চলতে থাকবে। আমরা শুধু আশা করবÑ‘এই দিন, দিন নয় আরও দিন আছে…। ’ সেই অনাগত দিনে গরিব ধনী হয়ে যাবে তা বলছি না, তবে জীবনের নূন্যতম চাহিদাÑআহার, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাÑপূরণের সুযোগ তাদের আমরা দেব। আমরা, মানে রাষ্ট্রের সবটুকু সুযোগ-সুবিধা চুষে খেয়ে ওদের উদ্দেশে আঁটিটা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি যে সুবিধাভোগীরা, তারা।

দুই.
কথায় কথায় যখন চোষাচুষির প্রসঙ্গ এসে গেল তা হলে, আসুন, সেই আম চোষার গল্পটা আপনাদের শুনিয়ে দিই। এক লোক রাস্তা দিয়ে যেতে আমের একটা চোষা আঁটি দেখতে পেল। কেউ একজন আম খেয়ে আঁটি চুষে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। চারদিকে তাকিয়ে দেখে লোকটি আঁটিটি তুলে নিল আরও ক’টা চোষন দেওয়ার জন্য। কিন্তু হা-হতোস্মি! আঁটিটিতে চোষার মত আর কিছু অবশিষ্ট নেই। তখন সেই লোকটির কাসিক উক্তি : ছিঃ…, লোকটা কী ওঁচা। কিছুই বাকি রাখেনি।
কী? তেমন মজা পেলেন না মনে হয়? পাবেন কী করে, ওই আঁটিতে তো আর সার পদার্থ কিছু ছিল না! তা হলে এটা কেমন লাগে দেখুন তো। এটাও আমের আঁটি নিয়ে। এক লোক পড়ন্ত বিকেলে খেতে গেছে সদরঘাটের এক পেটচুক্তি হোটেলে। গিয়েই মাছ-ভাত-সব্জির সঙ্গে অর্ডার ছিল আম-ডালের। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখে আমের যে আঁটিটি ডালের মধ্যে দেওয়া হয়েছে তাতে আছে বলতে কাঠের টুকরোর মত শুধু আঁটি, আমজাতীয় কিছু নেই। লোকটি রেগেমেগে হোটেলের বয়কে ডেকে বলল, এই মিয়া, এটা কী ধরনের ফাজলামি, আম-ডালের কথা বলে দিয়েছ শুকনা খটখটা একটা আঁটি। এতে আম কই? ঢাকাইয়া বয় নির্বিকারভাবে জবাব দিল : সকাল থাইক্যা সাতচল্লিশজন কাস্টুমার একটা আঁটিরে চুষলে হের মধ্যে কি আর কিছু থাহে? আমের আঁটি অইছে তো কী অইছে, হে কি মানুষ না, ভাইজান?
আমজনতাকে চুষতে চুষতে আমরা ওই হোটেলের আমের আঁটি বানিয়ে ফেলেছি। এখন আর জানতেও চাই না, ওরা কি মানুষ?

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

বাংলাদেশ সময়: ১৬:৪৫:০৭   ৩৯৭ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

মুক্তমঞ্চ’র আরও খবর


একীভূত শিক্ষা ব্যবস্থা কেনো?
ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতি
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে
আমার দেখা নিউইয়র্ক শহর
মুদ্রাস্ফীতিতে বাংলাদেশ
রোগীর সম্পৃক্ততাই তার নিরাপত্তা
বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের প্রেরণা
বেদনায় ভরা দিন
অর্থনীতিতে নার্সারিশিল্প
এলসি, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও উত্তরণ



আর্কাইভ