আধুনিক কবিতায় ছন্দের ব্যবহার

প্রচ্ছদ » সাহিত্য ও সংস্কৃতি » আধুনিক কবিতায় ছন্দের ব্যবহার
শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩



---

 

: জসীম উদ্দীন মুহম্মদ :

সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে নিঃসন্দেহে ছড়া এবং কবিতা সবচেয়ে জনপ্রিয়। অনলাইন কিংবা অফলাইনে যারা সাহিত্যচর্চা করেন তাদের লেখা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষই ছড়া লিখেন কিংবা কবিতা লিখেন। প্রবন্ধ, গল্প, ফিচার ইত্যাদি একেবারেই লিখেন না বিষয়টি তা নয়। এগুলোও প্রচুর লেখা হচ্ছে। কিন্তু ছড়া ও কবিতার তুলনায় তা একেবারেই নগণ্য। আর ছড়া মানেই ছন্দের খেলা। মাত্রার হিসাব-নিকাশ। তা স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত এমনকি অধুনা প্রচলিত মিশ্রবৃত্ত যে কোনোটিই হোক না কেন! সুতরাং ছড়াকে আমাদের আজকের আলোচনার বাইরে রাখতে চাই। আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় হলো- আধুনিক কবিতায় ছন্দের ব্যবহার। প্রসঙ্গত, আধুনিক কবিতা বলতে আমরা কী বুঝি, এ বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। অন্যথায় আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। কারো কারো মতে আধুনিক কবিতা হলো- মানুষের মনের চিরপদার্থ একজন কবির কবিতায় যে বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক কবিতা বলে।

তবে আধুনিক কবিতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করাটাও একটি চরম আপেক্ষিক বিষয়। কেননা, এ ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই নানাজন নানা মত দেবেন। তবে আমার নিজস্ব মতামত হলো- আধুনিক কবিতা হলো শব্দের মায়াজাল সৃষ্টি করা। অল্প শব্দে এবং বাক্যে হাজার হাজার শব্দ বা বাক্যের ভাবার্থ বা ব্যঞ্জনা ধারণ করা। অল্প কথায় পাঠককে বেঁধে রাখা এবং বিস্তীর্ণ ভাবনায় ডুবে যেতে একপ্রকার বাধ্য করা। ছন্দ, উপমা, অলঙ্কার, রূপ-রস, অনুপ্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়পটে একটি সার্থক কল্পচিত্র প্রতিষ্ঠিত করা। আরো সহজভাবে করে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রাচীন এবং মধ্যযুগের কবিতাকে পৃথককারী কবিতাই আধুনিক কবিতা।

এবার আসা যাক আধুনিক কবিতায় ছন্দের ব্যবহার প্রসঙ্গে। অন্যান্য অনেক আপেক্ষিক বিষয়ের মতো এই বিষয়টি নিয়েও বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। কেউ কেউ আধুনিক কবিতায় ছন্দের ব্যবহারকে দোষণীয় কিছু মনে করেন না; বরং উৎসাহিত করেন। আবার অন্য একটি পক্ষ আধুনিক কবিতায় ছন্দের ব্যবহারকে গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচনা করেন। আমার বক্তব্য বা অবস্থান এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সু¯পষ্ট। আধুনিক কবিতায় ছন্দের ব্যবহার করা বা না করার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে কবিতার প্রয়োজনের ওপর। কবিতার ভাববস্তুর ওপর। একটি কথা একেবারে সুস্পষ্ট যে, ছন্দের ব্যবহার করলেই কবিতা ছড়া হয়ে যাবে না। কিংবা ছড়া কবিতা হয়ে যাবে না। কারণস্বরূপ বলা যায়, আধুনিক কবিতা ও ছড়ার গাঠনিক কাঠামো সম্পূর্ণভাবে আলাদা। ছন্দের কারুকাজ কবিতা ও ছড়া নির্ণয়ের একমাত্র মাপকাঠি নয়। ছড়া ও কবিতার পার্থক্য নির্ধারণকারী আরো অনেক জীবন্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, ছন্দ বা অন্ত্যমিল যদি কবিতার গতরকে লাবণ্যময় করে, সুষমা দান করে সর্বোপরি অলঙ্কৃত করে তাহলে আধুনিক কবিতায় ছন্দের ব্যবহার দোষণীয় তো নয়ই; বরং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যম-িত।

যদিও পাশ্চাত্য সাহিত্যে আধুনিক কবিতার ইতিহাস অনেক পুরনো; কিন্তু আমাদের বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতাকে এখনো নবিসই বলতে হবে। অনেকে বাংলা সাহিত্যে প্রথম আধুনিক ধারার কবি হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে গণ্য করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে মাইকেলের ‘কপোতাক্ষ নদ’ কবিতাসহ আরো কিছু কবিতাকে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনা হয়। আমার মতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামও আধুনিক ধারার অসংখ্য কবিতা লিখেছেন এবং তারাও আধুনিক কবি।

এই যেমন ধরুন, কাজী নজরুলের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। আধুনিক কবিতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এর চেয়ে আর কী হতে পারে? নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ উভয়ের অনেক লেখায় গদ্যের সাথে ছন্দের সাযুজ্য বেশ ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হয়। তবে বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাশকে প্রথম আপাদমস্তক আধুনিক ধারার কবি হিসেবে মনে করা হয়। জীবনানন্দ দাশের প্রায় সব কবিতাই আমি পড়েছি। যেখানে মুক্তগদ্যের সাথে ছন্দের ব্যবহার সবিশেষ লক্ষণীয়। এই যেমন বনলতা সেন কবিতার থেকে অংশ বিশেষের উদ্ধৃৃতি দিচ্ছি-

‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,/আমারে দু-দ- শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।’

তিনি আরো লিখেছেন, ‘তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?/পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।… এখানে মুক্তগদ্যের সাথে ছন্দের সাযুজ্য অত্যন্ত মনোরম ও লাবণ্যময়। আধুনিক গদ্য কবিতার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- এখানে ছড়ার মতো ব্যাকরণ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। কবি যা-ই লিখেন না কেন ভুল ধরার তেমন কোনো অবকাশ থাকে না। তবুও কবির অন্তর সবসময় পাঠকের ভালোবাসা চায়। পাঠকের হৃদয়ের এককোণে কবি স্থান করে নিতে চান। আর তাই কবির কবিতাকে হতে হবে, সার্থক কবিতা। সার্থক কবিতা ছাড়া বাকি কবিতারা বেঁচে থাকবে না। বেঁচে থাকার কথাও নয়।

জীবনানন্দ দাশের পরে যারা বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতা লিখে খ্যাতি কুড়িয়েছেন, তাদের মধ্যে আল মাহমুদ অন্যতম। এবার প্রিয় কবি আল মাহমুদের কবিতায় ছন্দের ব্যবহার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেয়ার চেষ্টা করি। আল মাহমুদের ‘নোলক’ কবিতার কথাই ধরা যাক। ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।/নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তুমার কাছে?/-হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।/বলল কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে/শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছাড়িয়ে থাকে।’ কী অসাধারণ দেশাত্মবোধক একটি কবিতা।

এই কবিতার প্রতি দুই লাইনের শেষের শব্দে অন্ত্যমিল লক্ষণীয়। প্রিয় পাঠক, এই অন্ত্যমিল বা ছন্দের কারণে কবিতাটিকে কি ছড়া মনে হয়? আমি মনে করি, কখনো তা নয়; বরং ছন্দের কারণে কবিতাটি আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়াও আল মাহমুদের বিখ্যাত ও জননন্দিত কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’ও সনেট-জাতীয় ছন্দে লেখা।

বাংলাদেশ সময়: ১৯:৪৬:০৭   ২৫৮ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য ও সংস্কৃতি’র আরও খবর


ভোলায় দিনব্যাপী ঈদ আনন্দমেলা
দিলরূবা জ্যাসমিনের উপন্যাস “তবুও ছুঁয়ে যায়”- এর মোড়ক উন্মোচন
আজকের ভোলা প্রতিনিধি কবি নুরুল আমিনের কাব্যগ্রন্থ ‘ধান শালিকের কাব্যমালা’ প্রকাশ
দৌলতখানের কৃতি সন্তান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কবি হায়াত মাহমুদ অসুস্থ ॥ সকলের দোয়া প্রার্থী
ভোলায় বর্নাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হল গণজাগরনের সাংস্কৃতিক উৎসব
ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের সাহিত্য
কারার ঐ লৌহকপাট
উপমা না বুঝলে সাহিত্য বোঝা দায়
ভোলার দুই দিনব্যাপী সাহিত্য মেলার শুরু
উপন্যাস : রীতি ও প্রকৃতি



আর্কাইভ