হুমায়ূন আহমেদ : অনন্য কথাশিল্পী

প্রচ্ছদ » সাহিত্য ও সংস্কৃতি » হুমায়ূন আহমেদ : অনন্য কথাশিল্পী
শুক্রবার, ১৪ জুলাই ২০২৩



---

 

 

।। কাজী ইমাম রত্ন ।।

 

হুমায়ূন আহমেদ রসায়ন বিজ্ঞানের অধ্যাপক। স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক। মোহ সৃষ্টিকারী লেখক। নির্মাতা হিসেবে বর্ণিল। সাথে জড়িয়ে রয়েছে ব্যক্তিজীবনের রৌদ্র-ছায়া ট্র্যাজেডি। মেধাবী শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ পেশা শিক্ষকতা ছেড়ে সাহিত্যচর্চা বেছে নেন। তিনি বাংলা কথাসাহিত্যকে নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ প্রথম সারিতে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। ওয়াকিবহাল মহল নিজ উপলব্ধি থেকে মূল্যায়ন করেন, করবেন। যে যার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, লেখেন, সমালোচনা করেন এবং করবেন। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েও যে যার মতো বলার অধিকার রাখেন।

হুমায়ূন আহমেদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কুতুবপুর। জেলার মোহনগঞ্জে মাতুলালয়ে তার জন্ম। পিতা ফয়জুর রহমান, মাতা আয়েশা ফয়েজ। বাবা পুলিশ বিভাগের চাকুরে। বাবার চাকুরীর সুবাদে হুমায়ূন আহমেদের পরিবারকে সিলেট পঞ্চগড় বগুড়া চট্টগ্রাম কুমিল্লা পিরোজপুরে থাকতে হয়েছে। ১৯৬৫ সালে বগুড়া জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগে। ১৯৭০ সালে অনার্স ও ১৯৭২ সালে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। মুহসীন হলের ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালে আমেরিকা থেকে পলিমার রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে লেখালেখিকেই পেশা হিসিবে গ্রহণ করেন।

হুমায়ূন আহমেদের বাবা ফয়েজ আহমেদ স্বাধীনতাযুদ্ধে ’৭১ সালে পিরোজপুরে শহীদ হন। শামসুর রহমান ছিল হুমায়ূন আহমেদের নাম। হুমায়ূন আহমেদের লেখা থেকে জানা যায়, তার পিতা ছেলেমেয়েদের নাম পরিবর্তন করতে পছন্দ করতেন। সেই সূত্রে শামসুর রহমান আজকের হুমায়ূন আহমেদ। ছয় ভাই বোনের মধ্যে হুমায়ুন আহমেদ বড়। শহীদ পিতা ফয়েজ আহমেদ সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। পারিবারিক সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার অনুকূলে শৈশব অতিবাহিত করেন হুমায়ূন আহমেদ। পরিবার থেকেই তার লেখালেখির প্রেরণা।

তার প্রথম দু’টি উপন্যাস নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগার বাংলা ভাষার পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। কথাসাহিত্যিক হিসেবে পেয়ে যান খ্যাতি। একজন সফল সাহিত্যিক হিসেবে তাকে এনে দেয় অসাধারণ জনপ্রিয়তা। তার বুদ্ধিগত উপস্থাপনা, হাস্যরসবোধ পাঠক হৃদয় স্পর্শ করে। সাহিত্যে সৃষ্টি করেন স্বতন্ত্র ধারা। আমি ব্যক্তিগতভাবে, তার অনেক বই এক বসাতে পড়ে শেষ করেছি। অসংখ্য পাঠককেও একই কথা বলতে শুনেছি। তার লেখা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ জোসনা ও জননীর গল্প, শ্যামল ছায়া, আগুনের পরশমণি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের সম্পদ।

পাশ্চাত্যের হোমার, শেক্সপিয়ার, বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রমুখ লেখক,নাট্যকার, উপন্যাসিক ও সাহিত্যিকগণ, রাজা-বাদশাহ এবং আভিজাত্যের জীবনবোধকেন্দ্রিক সাহিত্য রচনা করেছেন। এসব সাহিত্য ছিলো পাশ্চাত্যের ধারায়। নানা বিবর্তনের পথ ধরে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচনা করেন ভাবগম্ভীর সাহিত্য। মধ্যবিত্তের হ্যাঁ না, সীমাবদ্ধতার উপাখ্যানকে কথাসাহিত্যে রূপ দেন তিনি। ফলে বাংলা কথাসাহিত্যের বিবর্তন ঘটে বেশ। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। সাহিত্য পৌঁছে যায় সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায়। শুরু হয় সাহিত্যে বিনোদন আর সাহিত্য অর্থনীতির ভিন্ন মাত্রা।

হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন যাপনের রহস্য নিয়ে। মধ্যবিত্ত নিয়ে সৃষ্টি করেন অসাধারণ সব সাহিত্যভাণ্ডার। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ, মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন টানাপড়েন, আবেগ, অভিমান, হতাশা, বঞ্চনা মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা অসাধারণ নৈপুণ্যে উপস্থাপন করেন তিনি। গড়ে ওঠে তার সুবিশাল পাঠকগোষ্ঠী। বিশেষত আমাদের তরুণসমাজ হয় বইমুখী। চার পাশের সাধারণ আবহে সুন্দরের আবিষ্কার, চটুল বর্ণনা, ব্যতিক্রমধর্মী সংলাপ, মোহনীয় ব্যঞ্জনায় নবধারা সৃষ্টি করেন হুমায়ূন আহমেদ। সব প্রেক্ষাপটে ক্যারিশমেটিক উপস্থাপনার ‘নান্দনিক সূত্র’ রেখে যান তরুণ প্রজন্মের সাহিত্যিক ও নির্মাতাদের কাছে। সাধারণ, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, প্রান্তিক, মেধাবী, কম মেধাবী, রহস্যময় চরিত্র বিনির্মাণে হুমায়ূন আহমেদের জুড়ি মেলা ভার। তার উত্থান আশির দশক থেকে। তিনি নির্মাণ করেন টিভি সিরিজ। দেশের উঠতি সমাজ টিভির সামনে বসতে শুরু করে বিনোদনের প্রত্যাশায়। এ সময় টিভি বিনোদনের প্রসার ঘটে। সৃষ্টি হয় নতুন সাংস্কৃতিক চেতনা। উৎসুক জনতা ব্যাকুল হয়ে থেকেছেন হুমায়ূন আহমেদের লেখা টিভি নাটক দেখার আগ্রহে। সেই সময় রাত আটটার সংবাদের পর হুমায়ূন আহমেদের টিভি নাটক দেখার জন্য রাজপথ ফাঁকা হয়ে যেত। নব চেতনায় বুভুক্ষু দর্শককুল বসে পড়তেন টিভির সামনে, শত ব্যস্ততা আড়াল করে।

হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্র নিয়ে রাজপথে মিছিল হয়েছে, এমন ঘটনা সাহিত্যের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। বাঙালি সমাজের ছোট ছোট জীবনপ্রবাহ অসাধারণ ক্যারিশমায় উপস্থাপন করেছেন তিনি। উপস্থাপন করেছেন মেধা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে জীবন ব্যঞ্জনার সৌন্দর্য, হৃদয়গ্রাহী ও অসাধারণ উপস্থাপনা হুমায়ূন আহমেদকে পৌঁছে দিয়েছেন অন্য উচ্চতায়।

হিমু ও মিসির আলী তার সৃষ্টির ভিন্ন ধারার দু’টি চরিত্র। হিমু চরিত্রে একটি সূক্ষ্ম ও অনন্য চেতনা বোধ লক্ষনীয়। একই সাথে হিমু চরিত্র রহস্যময়। যে কিনা বাস্তবতার ধারই ধারে না। প্রবল প্রতিকূলতা এবং শূন্যতায়ও নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে সে। হিমুকেন্দ্রিক হুমায়ূন আহমেদের গ্রন্থ দরজার ওপাশে, চলে যায় বসন্ত, হিমুর নীল জোছনা, হিমুর হাতে কয়টি নীল পদ্ম ইত্যাদি।

মিসির আলী চরিত্রটি বাস্তববাদী, মনস্তাত্ত্বিক, স্থান কাল পাত্র, বিশ্বাস, যোগ্যতা ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার অসাধারণ চরিত্র। নিশীথিনী, দেবী, বৃহন্নলা, মিসির আলীর চশমা, তন্দ্রা বিলাস ইত্যাদি… মিসির আলীর চরিত্রকেন্দ্রিক গ্রন্থ।

এইসব দিনরাত্রি, আমার আছে জল, ছায়া সঙ্গী, অয়োময়, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, বৃক্ষকথা, লীলাবতী, তিন পুরুষ, বৃষ্টি বিলাস, হুমায়ূন আহমেদের হাতে পাঁচটি নীল পদ্ম, মধ্যাহ্ন তার অন্যতম সৃষ্টি। সায়েন্স ফিকশন, মুক্তিযুদ্ধ ও জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমা, নাটক, উপন্যাস ও সমসাময়িক বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের রচনা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তরুণ লেখক, সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব, নাট্যজন, চিত্রনির্মাতাদের কাছে হুমায়ূন আহমেদ রোল মডেল। এখনও বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের স্টলে দর্শকদের ভিড় দেখে সমালোচকরা তাজ্জব বনে যান।

পাঠক সৃষ্টি ও তরুণদের পড়ার টেবিলে ধরে রাখতে হুমায়ূন আহমেদ জাদুকরী প্রতিভা। একসময় টিফিনের টাকা জমিয়ে তরুণরা মাসুদ রানা ও হুমায়ূন আহমেদের বই কিনেছে যা প্রবাদতুল্য। কোনো জাতির সৃজনশীলতার মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয় ঐ জাতির কত শতাংশ মানুষ বই পড়েন। সুতরাং বই পাঠে আগ্রহ সৃষ্টি করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সফলভাবে করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। পাঠক তৈরির নন্দিত কথাশিল্পী, দর্শকের ভাব ও মনো ব্যঞ্জনায় তিনি অগ্রগামী। মানুষের স্বাদ, সাধ্য ও স্বার্থের সীমাবদ্ধতা প্রকৃতির নিয়মে আবর্তিত। ব্যক্তিজীবনের কিছু আলো ছায়া হুমায়ূন আহমেদের কাছের স্বজনদের প্রভাবিত করেছে। স্বজনরা হুমায়ূন আহমেদের প্রতিভার দ্যুতিতে অগ্রসর সমাজের চেনা মুখ।

রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ড. হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টির প্রাচুর্যের ছায়ার কাছে, আমরা অভিযোগ ও অভিমানের তেজ ভুলে থাকতে চাই। তিনি বাংলা সাহিত্যকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, তা অমূল্য অর্জন। হুমায়ূন আহমেদের স্বজনরা তার সীমাবদ্ধতার কষ্টকে ভুলে যাবেন, এটা আমাদের বিনীত চাওয়া। সাহিত্যের পরিমণ্ডলে হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র।

হুমায়ূন আহমেদকে বিচার করতে হবে তার জায়গা থেকে। তিনি প্রায়ই বলতেন- আমি সাহিত্য করি আমার আনন্দের জন্য। এটি সত্য- তিনি তার আনন্দের জন্য সাহিত্য করতেন। কিন্তু মজার বিষয় হলো তিনি তার আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছেন তার পাঠক মহলে। এটিই হুমায়ূনের সার্থকতা।

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৪২:০৪   ৩৭২ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য ও সংস্কৃতি’র আরও খবর


ভোলায় দিনব্যাপী ঈদ আনন্দমেলা
দিলরূবা জ্যাসমিনের উপন্যাস “তবুও ছুঁয়ে যায়”- এর মোড়ক উন্মোচন
আজকের ভোলা প্রতিনিধি কবি নুরুল আমিনের কাব্যগ্রন্থ ‘ধান শালিকের কাব্যমালা’ প্রকাশ
দৌলতখানের কৃতি সন্তান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কবি হায়াত মাহমুদ অসুস্থ ॥ সকলের দোয়া প্রার্থী
ভোলায় বর্নাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হল গণজাগরনের সাংস্কৃতিক উৎসব
ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের সাহিত্য
কারার ঐ লৌহকপাট
উপমা না বুঝলে সাহিত্য বোঝা দায়
ভোলার দুই দিনব্যাপী সাহিত্য মেলার শুরু
উপন্যাস : রীতি ও প্রকৃতি



আর্কাইভ