বিজলির প্রেম

প্রচ্ছদ » সাহিত্য ও সংস্কৃতি » বিজলির প্রেম
শনিবার, ১ জুলাই ২০১৭



---
রাজিউল হাসান
গরমকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দিতে চাইছে শীত। কিন্তু গরমও নাছোড়। উভয়ের দ্বৈরথে প্রকৃতীতে এক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার আনাগোনা। ঠিক যেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। শেষ সময়ে এসে সরকারি দলকে টেনেহিঁচড়ে নামাতে চায় বিরোধী দল, আর সরকারি দল থেকে যেতে চায় মসনদে। ফলাফল, জনমনে উৎকণ্ঠা, দেশে কখনো উত্তেজনা কখনো থমথমে ভাব, রাজনৈতিক দ্বৈরথের মাঝে পড়ে জনগণের ঘুম হারাম। গভীরতার অতলে ডুবে আবার প্রভাতের পানে ছুটে চলেছে রাত। ঘড়ির কাটায় ঠিক তিনটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। কুয়াশার চাদর ধরণিকে আবৃত করতে চাইলেও কেমন একটা গুমোট-গরমভাব। এতো রাতেও স্টেশন বেশ সরগরম। দিনের বেলায়ও মফস্বলের এ স্টেশন অনেক সময় এতটা জাগ্রত থাকে না। সবাই ট্রেনের অপেক্ষায়; আন্ত:নগর যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেন। স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষারত যাত্রীসাধারণকে একটু খেয়াল করলেই দারুন কিছু ব্যাপার চোখে পড়ে। প্রথমত, চিলে কান নিয়ে যাওয়ার প্রবাদটা এক্ষেত্রে শতভাগ সত্য। কেউ একজন ট্রেন আসছে উল্লেখপূর্বক নিজ লাগেজ নাড়াচাড়া শুরু করলেই হল, ধীরে ধীরে পুরো স্টেশন জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে ব্যস্ততা। আবার এদের মধ্যে কিছু অতি উৎসাহী যাত্রী প্লাটফরমের শেষপ্রান্তে গিয়ে ট্রেন আসার পথে উঁকিঝুকি মেরে যখন নিশ্চিত হবে, আসছে না যান্ত্রিক সাপটা, তখন আবার যাত্রীসাধারণের ব্যস্ততায় ভাটা পড়বে। অপর যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি লক্ষ্যণীয়, এমনিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন অপচয় হয়ে গেলেও মানুষের অনেক ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব থাকে কিন্তু ট্রেন আসার নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাওয়ার পর প্রতিটা মিনিটের হিসাব রাখে সবাই। এই যেমন আজ সঠিক সময়ের পর পঁয়ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেলেও যমুনা এক্সপ্রেসের দেখা নেই, এ কথা এই স্টেশনের ছেলে-বুড়ো, মূর্খ-শিক্ষিত সব যাত্রীরই জানা।
বছরের দ্বিতীয় এবং শেষ উৎসব, কোরবাণীর ঈদ পালনপূর্বক আজ আমি রাজধানীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছি। সময়-বিবেক একত্রে বলা শুরু করেছে, এবার কাজে যোগদানের পালা। যাওয়ার কথা ছিল আরো দু’দিন আগে কিন্তু মিছে অসুস্থ্যতার কথা বলে ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছি। বাবামা’র দাবি পূরণ করতেই এমন মিথ্যের আশ্রয়। বরাবরের মতো এবারও বাবা আমার সাথে স্টেশনে এসেছেন ট্রেনে তুলে দেবেন বলে। বাসা থেকে স্টেশন পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ হলেও বাবার তোড়জোড়ে আধঘণ্টা আগে চলে এসেছি। বাবা এক অদ্ভুত মানুষ। বাড়ি যাওয়ার দিন স্টেশনে আমার অপেক্ষায় থাকা আর চলে আসার দিন ট্রেনে তুলে দেওয়া তাঁর অন্যতম প্রিয় কাজ। বাবার এহেন কর্মের কারণে কখনো কখনো পরিচিতমহলে টিপ্পনীর শিকার হতে হলেও কখনো বাঁধা দেই নি আমি। সন্তান হিসাবে কোনো দায়িত্বই তো পালন করতে পারি নি আজ পর্যন্ত, তারওপর প্রিয় কর্মটাও যদি ছিনিয়ে নেই, তবে চরম অধর্ম হয়ে যাবে!
আঁধারের বুক চিরে এক সময়ের আলোর রেখা দেখা গেল। মানুষের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। ট্রেন প্লাটফরমে ঢোকার আগেই সবাই যেন ট্রেনে উঠতে ব্যতিব্যস্ত। অবশেষে হৈ-হট্টগোল ছাপিয়ে দানবীয় শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ধীরেসুস্থে হেলেদুলে স্টেশনে এসে ঢুকল সে। অন্য সবার সাথে নেমে পড়লাম যুদ্ধক্ষেত্রে। আমি তখন ট্রয়ের উপকূলে অ্যাকিলিসের ভূমিকায়। যেভাবেই হোক ট্রেনের দরজায় পা রাখতেই হবে। অনেক ধাক্কাধাক্কি শেষে গলদঘর্ম হয়ে অবশেষে নিজ আসনের কাছে পৌঁছালাম। আয়েশ করে বসলাম। ট্রেন তখন লোকে লোকারণ্য। চলতে শুরু করেছে। পা ফেলার জায়গাটা পর্যন্ত নেই ভেতরে। নিজ আসনে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আমার। ট্রেনের শব্দ আর ঝাঁকুনির মধ্যে এক নীরবচ্ছিন্ন সুর আছে, যেমনটা আছে টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দে। কবি-সাহিত্যিক বা রসবোঁধ সম্পন্ন মানুষ হলে নির্ঘাত বসে যেতাম কাগজ-কলম হাতে, নতুবা হারাতাম উদাস ভাবনায়। কিন্তু বড্ড কাঠখোট্টা মানুষ আমি, রসবোঁধের যথেষ্ট অভাব। এমন সঙ্গিতে আমার ঘুম চাপে। এবারও ব্যতিক্রম কিছু ঘটে নি।
ভোর ছ’টা নাগাদ প্রতিদিনের অভ্যাশবশত ঘুম ভেঙে গেল। ট্রেন তখন উর্ধ্বশ্বাসে ঢাকা অভিমুখে ছুটছে। রাতের সমাপ্তি ঘটিয়ে দিনের প্রথম নরম আলো আলতো ছুঁয়ে যাচ্ছে পৃথিবীকে। জানালার বাইরে বৃক্ষরাজি, পথ-ঘাট, ফসলের মাঠ সবই উল্টো পথে ছুটে চলেছে। ঘুম ঘুম ঝাপসা চোখে বাঁয়ে তাকাতেই চক্ষুস্থির হয়ে গেল আমার। ক্ষণিকের তরে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল হৃদয় আর ফুসফুসের মতো। আর এ কারণেই নির্লজ্জের মতো কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। কী বিশেষণে তাকে বিশেসায়িত করব, ভেবেই পেলাম না। সে কী পরী, নাকি দেবী, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। সাজ-সজ্জার আড়ম্বর নেই, নেই নিজেকে অতূলনীয়া করে তোলার ঘণঘটা, তবু সে অনন্যা। সবচেয়ে বড় আশ্চর্য, এতো এতো মানুষের মধ্যে হঠাৎ কোত্থেকে সে ঠিক আমার সামনে এসে পড়ল, বুঝতে পারছি না। দুই দিকের দরজার যে অবস্থা, তাতে কারোর পক্ষেই ভেতরে আসতে পারার কথা না। আর যতদূর মনে পড়ে, যাত্রার প্রারম্ভে যখন দু‘চোখের পাতা এক হচ্ছে আমার, তখনও সে এখানে ছিল না। দেবীর কিঞ্চিৎ গুটিয়ে যাওয়া চোখে পড়তেই মস্তিষ্ক আবার কাজ করতে শুরু করল। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও দৃষ্টি ফিরিয়ে জানালায় হানলাম। দেবী যেন এক প্রচ- শক্তিধর চুম্বক আর আমার চোখজোড়া লৌহচূর্ণ। সুন্দরের বিপরীতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখতে কী যে কষ্ট, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ক্ষণে ক্ষণে কারণে-অকারণে চোখ শুধু বাঁয়ে ছুটে যাচ্ছে, মন তো পড়ে রয়েছেই সেখানে। হঠাৎ দেবীর পা বদল করে ভর দিয়ে দাঁড়াতে দেখে কেমন যেন মায়া হল! ইচ্ছে হল নিজ আসনটা ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে দেই। কিন্তু এসব আমার অভ্যাসে নেই। সারাবিশ্ব যখন নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার, আমি একাই তখন পুরুষবাদি এক যুবক। এমন না যে, আমি নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে, মূলত আমি নারী-পুরুষ উভয়ের প্রকৃত সমঅধিকারের পক্ষে। কী, পাগলের মতো শোনাচ্ছে? গতানুগতিকতার বাইরে কিছু বললেই মানুষ পাগল ভাবে। সহজ একটা উদাহরণ দেই। দেশে নারী শিক্ষার প্রসারে সরকার কতশতই না পদক্ষেপ নিচ্ছে, অথচ এদেশে এখনো অনেক পরিবার আছে যার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে ছেলে সন্তানটিকে বিদ্যালয়ের পথ ছেড়ে জীবিকার পথে পা বাড়াতে হয়। আমার যুক্তি উপবৃত্তি, অবৈতনিক শিক্ষা ইত্যাদি সুবিধা ছেলেদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হলে সমহারে এগিয়ে যাবে দেশ। আর যতদিন এমন না হবে, নিজ অবস্থান থেকে নড়তে পারব না আমি। দেবীকে আসন না ছাড়ার পেছনে অবশ্য এসব কোনো যুক্তি নয়। মূলত আমাকে আটকে দিয়েছে দেবীর আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো। যখন কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে বঞ্চিতদের তালিকায় আবিষ্কার করে অবাক হয়ে দেখি আমার প্রাপ্য স্বীকৃতী অথবা অবস্থান নিয়ে যাচ্ছে কোনো সুন্দরী, তখন এই আমিই কর্তৃপক্ষের চরিত্রের বংশোদ্ধার করি। অথচ আজ সম্পূর্ণই উল্টো প্রেক্ষাপট। পাশের আসনে বসা যাত্রী আমারই এক ছোটভাই। একই এলাকায় একই সাথে হেসেখেলে বড় হয়েছি। তার চাপাচাপিতেই একসময় দেবীর উদ্দেশ্যে বললাম, ‘ম্যাডাম, চাইলে আপনি আমার চেয়ারের হাতলে বসতে পারেন।’
দেবী স্মিত হেসে বার দুয়েক প্রত্যাখ্যান করে বসে পড়ল। উপায়ও ছিল না তার। ট্রেন যেন চলন্ত মৌচাক। আমি যেহেতু তাকে বসার অনুমতি দিয়ে দিয়েছি, অতএব তার পূর্ণ প্রত্যাখ্যানের অর্থ তা সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত। আর দু’চার মিনিট এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তার আর বসা হবে না। সামনের পুরো সাড়ে তিন ঘণ্টার রাস্তা দাঁড়িয়ে যেতে হবে। বুদ্ধিমতি দেবী আসন্ন বিপদ আঁচ করতে পেরে বসে পড়ল। এবার পরিচয়ের পালা। জানতে পারলাম, সে পরিবার সমেত ময়মনসিংহ থাকে; কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্রী; বাড়ি নারায়নগঞ্জ। সব জানা সত্ত্বেও নাম জানতে না পেরে মনটা কেমন খচখচ করছিল। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেসই করে বসলাম। মৌ। তার মতোই স্নি নাম। আমার তখন পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো অবস্থা। মাঝেমধ্যেই নড়াচড়ার কারণে ছোঁয়াছুয়ি হয়ে যাচ্ছিল, তার স্নি গন্ধ মাতাল করে দিচ্ছে আমাকে। আর কিছু পরপর তার কথা যেন নীরবতায় কাঁচের চুড়ি ভেঙে পড়ার আওয়াজ তুলছে কর্ণমূলে। প্রায় বোবা হয়ে গেছি আমি। এদিকে আমার সে ছোটভাই গল্পের ঝুলি খুলে বসেছে মেয়েটার সাথে। আমার শুনতেই বেশি ভালো লাগছিল, তাই নীরবে শুনে যাচ্ছিলাম। ট্রেনের অসম্ভব ভীড়, হঠাৎ ভেসে আসা উৎকট গন্ধ, হট্টগোল, ট্রেনের ঝিকঝিক ছুটে চলার শব্দ সব কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে তখন মৌ নামের অনন্যার কথা ধ্বণি-প্রতিধ্বণি তুলছে, মন মাতাল হয়ে আছে তার স্নিতায়। দেখতে দেখতে কখন বিমানবন্দর স্টেশনে চলে এসেছি, বুঝতেই পারি নি। কখনো কখনো সময় সত্যিই সময়ের চেয়ে দ্রুত ছুটে চলে। একসাথেই নামলাম। মেয়েটা আবারো তার অমায়িক হাসি উপহার দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আর আমি নীরব দর্শকের মতো তার চলে যাওয়া দেখতে থাকলাম। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, আর কখনো তার সাথে দেখা হবে না। সৃষ্টিকর্তার কী অপার খেলা! হঠাৎই মনের মতো মানুষ সামনে এনে হাজির করেন, আবার তাকে নিয়েও চলে যান বিদ্যুতের মতো। মাথার মথ্যে কিছু কথা ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার:
এক পলকের চোখাচোখি,
ক্ষণিক পরেই হাসি;
মিষ্টি মধুর কথামালা,
মিষ্টি হাসি বিদায়বেলা।
কেমন এ মানবজনম!
চেনার আগেই হারিয়ে যাওয়া!
আচমকা মনে পড়ল, মেয়েটাকে আমার নামটা পর্যন্ত বলা হয় নি। এমন প্রেমকেই প্রবীরদা ‘বিজলিপ্রেম’ নাম দিয়েছেন। বিজলির মতো হঠাৎ এসে সাদাকালো ম্যাড়ম্যাড়ে জীবনটাকে রঙিন করে দিয়ে আবার হঠাৎই হারিয়ে যায়!

বাংলাদেশ সময়: ১৮:৪০:৩৫   ৬২৩ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য ও সংস্কৃতি’র আরও খবর


ভোলায় দিনব্যাপী ঈদ আনন্দমেলা
দিলরূবা জ্যাসমিনের উপন্যাস “তবুও ছুঁয়ে যায়”- এর মোড়ক উন্মোচন
আজকের ভোলা প্রতিনিধি কবি নুরুল আমিনের কাব্যগ্রন্থ ‘ধান শালিকের কাব্যমালা’ প্রকাশ
দৌলতখানের কৃতি সন্তান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কবি হায়াত মাহমুদ অসুস্থ ॥ সকলের দোয়া প্রার্থী
ভোলায় বর্নাঢ্য আয়োজনে অনুষ্ঠিত হল গণজাগরনের সাংস্কৃতিক উৎসব
ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের সাহিত্য
কারার ঐ লৌহকপাট
উপমা না বুঝলে সাহিত্য বোঝা দায়
ভোলার দুই দিনব্যাপী সাহিত্য মেলার শুরু
উপন্যাস : রীতি ও প্রকৃতি



আর্কাইভ