বিশেষ প্রতিনিধি ॥
জলবেষ্টিত জেলা ভোলার ঐতিহ্যবাহী খাবার মহিষের দই। স্থানীয়ভাবে এটি ‘বৈষা দদি’ নামে পরিচিত। উৎসব-পার্বণে এর চাহিদা বাড়ে।
দই তৈরিতে দুধ আসে জেলার বিভিন্ন চরের মহিষের বাথান থেকে। জেলার পূর্ব দিকে মেঘনা, পশ্চিমে তেঁতুলিয়া, উত্তরে ইলিশা আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই উত্তাল জলরাশির মাঝে জেগে ওঠা চরে সবুজ ঘাসের বুকে চরে বেড়ায় মহিষ। সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা ১ লাখ ২৪ হাজার । তবে বেসরকারি হিসাবে তা দুই লাখের কাছাকাছি।
মুহাম্মদ শওকাত হোসেন রচিত ‘ভোলা জেলার ইতিহাস’ বই থেকে জানা যায়, ১২২০ সালের দিকে ভোলায় প্রথম চর জাগতে শুরু করে। প্রায় ১০০ বছর পরে, ১৩০০ সালের দিকে সেখানে চাষাবাদ শুরু হয়। ১৩৩৫ সাল নাগাদ দক্ষিণ শাহবাজপুরে (ভোলার আদি নাম) বসতি স্থাপন শুরু হয়। শাহবাজপুর ছাড়াও আশপাশের নদীতে জেগে ওঠে নতুন নতুন চর। মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর মাঝে জেগে ওঠা এ রকম শতাধিক চরে মহিষসহ গবাদিপশু চরে বেড়ায়। একসময় কার কত মহিষ আছে, তার ওপরে ব্যক্তির ক্ষমতা নির্ণয় হতো। মহিষের বাথান বদল হয়, ভাঙাগড়ার করুণ খেলা চলে। ক্ষমতা হারিয়ে যায় কিন্তু কাঁচা দইয়ের কদর কমে না।
ভোলার বিভিন্ন উপজেলার খামারি, দই বিক্রেতা ও সরকারি কর্মকর্তা, মহিষ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সারা বছরই কাঁচা বৈষা দইয়ের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি দই বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৫০ টাকায়। ঈদকে কেন্দ্র করে দাম আরও বেড়ে যায়। ঈদ শুরুর অন্তত দুই সপ্তাহ আগ থেকে দুধ সংগ্রহে রাখেন বিক্রেতারা। ঈদের পরেও এর চাহিদা থাকবে তুঙ্গে। এ সময় প্রতিদিন গড়ে ৮০০-৯০০ কেজি দই বিক্রি হয়ে থাকে।
ভোলার ঐতিহ্যবাহী মহিষের কাঁচা দুধে তৈরি দই
কাঁচা দই যে পাত্রে বসানো হয়, তাকে বলে টালি। এই টালিতে মহিষের কাঁচা দুধ ঢেলে একটু শুকনো স্থানে যতেœ বসিয়ে রাখলে ১৪-১৫ ঘণ্টা পর দই জমে। শীতে জমতে সময় বেশি নেয়। তবে শীতের দই খুবই সুস্বাদু। ওপরে পুরু স্তরের মাখন পড়ে। মনপুরা উপজেলায় দই বসায় বড় হাঁড়িতে। পরে বাজারে নিয়ে ছুরি বা চামচ দিয়ে কেটে কেজি দরে বিক্রি করে।
ঐতিহ্যবাহী কাঁচা দইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চর, মহিষ আর রাখফাল। জনবিচ্ছিন্ন চরগুলোতে রয়েছে বাথান। ধু ধু প্রান্তর। একটি বাথানে বাস করে কয়েকজন মালিকের হাজারখানেক মহিষ আর রাখফাল নামের অবহেলিত মানুষ। রাখওয়াল থেকে রাখাল বা রাখফাল। রাখালেরা থাকে কাদাজলের ওপর উঁচু মাচান করা টংঘরে আর মহিষ কেল্লায়। তবে গ্রামীণ জন-উন্নয়ন সংস্থা (জিজুস) ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) যৌথভাবে ভোলার বিভিন্ন চরে তিনটি আধুনিক কিল্লা বানিয়ে দিয়েছে। সেখানে মহিষ কাদাপানি থেকে উঠে এসে পাকা মেঝেতে রাত টাকায়। আর রাখালেরা পাকা ঘরে রান্না করে এবং পাকা ঘরে খাটের ওপর ঘুমায়। আছে সৌরবিদ্যুৎ ও বজ্রপাত নিরোধের ব্যবস্থা।
প্রতিদিন ভোরে দুধেল মহিষগুলোর দুধ দোহন করেন রাখাল। তখনই চরে হাজির হন দুধের ব্যাপারী, যাঁরা মালিকের কাছে বছরব্যাপী দুধ কেনার দাদন দিয়েছেন।
ভোলার ঐতিহ্যবাহী মহিষের কাঁচা দুধে তৈরি দই
ওই ব্যাপারীদের বলা হয় ঘোষ। ঘোষ আবার দুধ বিক্রি করে দই বিক্রেতাদের কাছে। তবে বর্তমানে ভোলায় বেশ কিছু গরু-মহিষের খামার হয়েছে। এখানে উন্নত জাতের ‘মুররা’ মহিষ পালন করা হয়। ঘোষেরা এসব খামার থেকেও দুধ কিনে নেন।
ভোলার বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী মশিউর রহমান জানান, মহিষের দই ছাড়া ভোলার কোনো অনুষ্ঠান হয় না। কিন্তু মহিষের দুধ উৎপাদন কম হওয়ায় এ নিয়ে চলে নানা কেরামতি। মেশিন কিংবা চরকি দিয়ে মাখন তুলে ফেলা ছাড়াও মহিষের দুধে গরুর দুধ মিশিয়ে ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের মান নষ্ট করা হচ্ছে। তবে চরাঞ্চলের কিছু হাটে ও ভোলা সদরের কোনো কোনো দোকান বিশুদ্ধ কাঁচা দইয়ের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
প্রায় ৪০ বছর ধরে বাথানভিত্তিক মহিষের আবাদ ও দইয়ের ব্যবসা করছেন ভোলা শহরের গাজীপুর রোডের আদর্শ দধি ভান্ডারের পরিচালক আবদুল হাই। তিনি জানান, মহিষের দুধ ঘন। পানির আধিক্য কম। মাটির পাতিলে দই পাতলে সে পানিটুকুও শুষে নেয়। ফলে নির্ধারিত সময়ের পরে দইয়ের ওপর ঘন মাখন জমে। ভোলাবাসী চিনি বা গুড় মিশিয়ে কিংবা অনেকে লবণ মিশিয়ে খান। এটা বহনযোগ্য। কিন্তু গরুর দুধ মেশালে দই পাতলা হয়। বহনযোগ্য থাকে না। গরুর দুধে দই বসে তবে স্বাদযুক্ত নয়। দ্রুত টক হয়ে যায়।
আবদুল হাই আরও বলেন, চরাঞ্চলে মানুষের বসত বাড়ার কারণে মহিষের চারণভূমি কমছে। ঠিকমতো ঘাস পাচ্ছে না, ফলে দুধ কমে যাচ্ছে। দুধের জোগানের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় বিক্রেতারা ভেজাল দিচ্ছে। দামও হাঁকছে বেশি। প্রাণিস¤পদ বিভাগের উচিত মহিষ খামারিদের সার্বিক সহায়তা করা।
ভোলার মহিষ উন্নয়নে ২০১৭ সাল থেকে ভোলার গ্রামীণ জন-উন্নয়ন সংস্থা (জিজুস) কাজ করছে। সংস্থার পরিচালক (প্রাণী) মহিষ বিশেষজ্ঞ ডা. খলিলুর রহমান বলেন, মহিষের খাদ্যসংকট দূর ও আন্তপ্রজনন রোধ করতে পারলে মহিষের মাংস ও দুধের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এ জন্য চরাঞ্চলগুলোতে মহিষের জন্য চারণভূমি ঘোষণা করাসহ বাথানে পর্যাপ্ত উন্নত জাতের বুল বিতরণ করতে হবে।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, তাঁর সংস্থা বিভিন্ন বাথানে এ পর্যন্ত ৪৪টি বুল ও ৩টি আধুনিক কিল্লা নির্মাণ করে প্রায় ১০ হাজার মহিষ থাকার ব্যবস্থা করেছে।
ভোলার সদর উপজেলার খামারি আক্তার হোসেন বলেন, তাঁর খামারে প্রায় ৪০০ গরু। চাহিদার তুলনায় দুধের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। খাবারের দাম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি ও দুধের দাম কম হওয়ায় তাঁর উৎপাদন খরচ উঠছিল না। তখন দুধের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর জন্য নানা রকম মিষ্টি, ঘি ও দই উৎপাদনে হাত দিয়েছেন। এখন তিনি লাভে আছেন।
ভোলার ঐতিহ্যবাহী মহিষের কাঁচা দুধে তৈরি দই
ভোলা জেলা প্রাণিস¤পদ কর্মকর্তা (ডিএলও) ইন্দ্রজিৎ কুমার ম-ল বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিন গড়ে ১৭০ মিলি দুধ পান করা ও কমপক্ষে ৫০ গ্রাম কাঁচা দই খাওয়া দরকার।
বর্তমানে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভোলায় দুধের উৎপাদন প্রায় সাড়ে ৩৬ হাজার ৪১৪ মেট্রিক টন বেড়েছে। ভোলার লোকসংখ্যা ২০ লাখ ৯৯ হাজার। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিদিন জনপ্রতি ১৭০ গ্রাম পান করলে, সে হিসাবে বছরে দুধের দরকার হয় প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার ২৪৩ মেট্রিক টন। কিন্তু বছরে ভোলায় দুধ উৎপাদিত হচ্ছে, প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬৫৭ মেট্রিক টন। বছরে উদ্বৃত্ত থাকে প্রায় ৩৬ হাজার ৪১৪ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন দুধ মহিষের। মহিষের দুধের সবটুকুতে কাঁচা দই উৎপাদন হলেও প্রায় দ্বিগুণ চাহিদা রয়েছে। মহিষের দুধের চাহিদা আছে প্রায় ৩৮ হাজার ৩০৮ মেট্রিক টন’ এই তথ্য দিয়েছেন ডিএলও।
খামারিদের ক্ষতি ঠেকাতে তাঁর সংস্থা চরফ্যাশনে একাধিক উদ্যোক্তা সৃষ্টি করেছে। এরা খাঁটি দুধে সুস্বাদু মিষ্টি, দই ও ঘি উৎপাদন করছে। এদের নিয়ে আজ আন্তর্জাতিক দুগ্ধ দিবসে তাঁরা মেলা আয়োজন করেছেন বলে জানিয়ে চরফ্যাশন উপজেলার পরিবার উন্নয়ন সংস্থার (এফডিএ) নির্বাহী পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ভোলা ও ভোলার বাইরের জেলায় এসব খাঁটি দুগ্ধপণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুধের বহুমুখী ব্যবহার বাড়ানোর জন্য এসব উদ্যোক্তাকে আর্থিক সহায়তও দিয়েছে তাঁর সংস্থা ও পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন।
বাংলাদেশ সময়: ০:২৮:৩৪ ২৫৮ বার পঠিত