জীবনের মূল্য ৮০ হাজার টাকা

প্রচ্ছদ » সম্পাদকীয় » জীবনের মূল্য ৮০ হাজার টাকা
শনিবার, ১০ জুন ২০১৭



গত মঙ্গলবার বিকেলে বেইলি রোডে রূপায়ণ হাউজিংয়ের নির্মাণাধীন ১৪ তলা ভবনের ১০ তলায় কাজ করার সময় লিফটের ফাঁকা জায়গা দিয়ে পড়ে নিহত হন সায়েম, জয়নুল, জাহাঙ্গীর নামে তিন শ্রমিক। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, লিফটের ফাঁকা জায়গায় পুরনো বাঁশের মাচার ওপর তারা কাজ করছিলেন। কোনো নিরাপত্তা জালও ছিল না। এখানে নির্মাণ কর্তৃপক্ষের অবহেলা স্পষ্ট। প্রথমত, ভেঙে পড়তে পারে এমন পুরনো মাচা থাকার কথা না। আর নিরাপত্তা জাল থাকলে তারা জালে আটকা পড়তেন। জীবনহানি হতো না। তাই এটিকে আর দুর্ঘটনা বলা যায় না। এটি হত্যাতুল্য অপরাধ। এ ধরনের দায়িত্ব অবহেলায় নির্মাণাধীন উড়াল সেতুর একাধিক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। পথচারীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ফাইওভারের বোল্ডার গাড়ির ওপর পড়ায় আরোহীর প্রাণ ঝরেছে। আমরা এসব ঘটনা জানি। কিন্তু জানি না, কত কান্না-অশ্রু জমাট বেঁধে আছে, কত পরিবার পথে বসেছে, কত মেধাবী শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ধুলায় মিশে গেছে।
তারা ভাবেন না, যাদের হাতের ছোঁয়ায় সুরম্য অট্টালিকা উঠছে, সেতু-রাজপথ নির্মিত হচ্ছে, কলকারখানার চাকা ঘুরছে; তারাই উন্নয়নের অগ্রপথিক। তাদেরকে উপেক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন হবে না। কিন্তু নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বা মালিকপক্ষ এসব কিছু থোড়াই কেয়ার করে। তাদের ধারণা, তাদের হাত অনেক লম্বা- এক হাত সরকার দলে, আরেক হাত বিরোধী দলে। সাধ্য কার তাদের হাত স্পর্শ করবে! এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও ঘটেছে। রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির পেছনে মালিকপক্ষের দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতি ছিল। বিষয়টি এখনও সুরাহা হয়নি। এমন ঘটনায় আজ পর্যন্ত দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিও। দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে এসব হরহামেশা ঘটত না। দেশের আইনের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে এ ধরনের ঘটনার বিচার করতে হবে, যাতে এমন ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও আর হেলাফেলা নয়। জীবন অমূল্য। টাকা দিয়ে ক্ষতিপূরণ হয় না। তারপরও কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনায় কেউ প্রাণ হারালে তখন টাকা দিয়েই দায় পরিশোধ করতে হয়। উল্লেখ্য, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান একজনকে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘মাস্টার মশাই’ গল্পে আছে- ইন্সপেক্টরের তিন ঠ্যাংয়ের কুকুরের ব্যয় মাস্টার মশাইয়ের বেতনের চেয়ে বেশি। তখন তিনি মনের খেদে বলেছিলেন, তার পুরো পরিবারের ব্যয় ল্যাংড়া কুকুরের কয় ঠ্যাংয়ের সমান। আজকের বাজারে ৮০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ সে গল্পটিই স্মরণ করিয়ে দেয়। কর্মস্থলে নিহত কোনো শ্রমিকের জীবনের ক্ষতিপূরণ কত হবে তার একটি আন্তর্জাতিক মানদ- রয়েছে। আমাদের দেশেও কর্মস্থলে নিহত শ্রমিকের পরিবারকে কত টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তা নির্ধারণের জন্য হাইকোর্ট একটি কমিটি করে দিয়েছিলেন। ওই কমিটিতে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকতা, মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি, অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তারা বিবেচনা করেছিলেন, একজন কত বছর কাজ করেন, এ সময়ে কত আয় করেন, তার পরিবারের সদস্যদের কত ক্যালরি খাদ্য প্রয়োজন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খরচসহ নানা সূচক বিবেচনা করে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এটি একটি যৌক্তিক হিসাব। দুর্ভাগ্যজনক যে, এই রিপোর্টটি আলোর মুখ দেখেনি। এটি প্রকাশ করা এখন সময়ের দাবি। এটি আইনে পরিণত করে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হলে অবহেলার সংস্কৃতি দূর হতো। আমরা রূপায়ণ হাউজিংয়ে শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনার বিচার, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও যৌক্তিক ক্ষতিপূরণের দাবি জানাই।

বাংলাদেশ সময়: ০:১৪:৩৯   ৩০৪ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সম্পাদকীয়’র আরও খবর


ডলার বাজারে অব্যাহত অস্থিরতা
ইন্টারনেট প্যাকেজ নিয়ে প্রতারণা
রাজনৈতিক সংলাপের তাগিদ : সমঝোতার বিকল্প নেই
বাজারে কারসাজি
নৌ দুর্ঘটনা রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করুন
চিকিৎসক ধর্মঘট: রোগীদের জিম্মি করে কর্মসূচি অনৈতিক
নৌযানে অগ্নিদুর্ঘটনা রোধে পদক্ষেপ নিন
ফিটনেসহীন নৌযান: ভোলা নৌপথে দ্রুত ব্যবস্থা নিন
চরফ্যাশনের ঢালচর বনের ঢাল কারা?
বাজারে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস : সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব দৃশ্যমান হচ্ছে না



আর্কাইভ