পহেলা বৈশাখ: বাঙালির সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব

প্রচ্ছদ » মুক্তমঞ্চ » পহেলা বৈশাখ: বাঙালির সার্বজনীন ও অসাম্প্রদায়িক উৎসব
মঙ্গলবার, ১৩ এপ্রিল ২০২১



॥ তানভীর রনি ॥

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের একমাত্র সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক একটি উৎসবের দিন। যেখানে সকল ধর্ম বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই সম্মিলিতভাবে উৎসব উদযাপন করে। পহেলা বৈশাখের রয়েছে  সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ঐতিহাসিক সূত্রমতে পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। যা চালু হয়েছিল বিশ্ব বিখ্যাত মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে তারই নির্দেশে। মূলত রাজস্ব সংগ্রহের সুবিধার জন্য আকবরের নবরতœ সভার অন্যতম মন্ত্রী আবুল ফজলের পরামর্শে নতুন ফসলী সন হিসেবে বঙ্গাব্দ চালু হয়েছিল। চালুর দিন থেকে হিজরী সনের তারিখ অনুযায়ী এ সাল গণনা শুরু হলেও এটা হিজরি সনের চন্দ্রবর্ষ পদ্ধতিকে বাদ দিয়ে সৌর বর্ষ অনুযায়ী কৃষকদের সুবিধার জন্য বঙ্গাব্দ নামে নতুন সন গণনা শুরু হয়। উদ্দেশ্য একটাই ছিলো কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সহজ ব্যবস্থা করা। আবুল ফজলের পরামর্শে হলেও এই বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের  যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করেছেন বাংলা আরেক সুযোগ্য সন্তান যিনি সম্রাট আকবরের অতি ঘনিষ্ঠজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তিনি হলেন ফতেউল্লাহ সিরাজী। যার নামে ফতুল্লাহ অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছে।

---

পহেলা বৈশাখ আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এর আছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। প্রাচীন কাল থেকেই এই দিনে এক দিকে খাজনা উসল হত, অন্যদিকে গ্রামে-গঞ্জে আয়োজিত হত বৈশাখী মেলা, লাঠি খেলা, নৌকাবাইচ সহ নানা ধরনের উৎসব। হিন্দু ধর্মের অনুসারীরা এই দিনে তাদের ধর্মীয় আচার অনুযায়ী পূজা পাঠ করত, আর এতদাঞ্চলের মুসলমানরা মিলাদ ও দোয়ার মাধ্যমে এ দিবসটি উদযাপন করতো। ব্যবসায়ীগণ হালখাতার মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছ থেকে পুরানো বকেয়া আদায় করতো এবং তাদের মধ্যে মিষ্টান্ন বিতরণ করতো। সবকিছু মিলিয়ে একটি ভিন্ন ধরনের উৎসবের আমেজে কেটে যেত বছরের প্রথম দিনটি।
গত কয়েক দশক যাবত বাংলা নববর্ষ উদযাপনে অনেক নতুন অনুষ্ঠানাদি পালন করা শুরু হয়েছে। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট এর ছাত্ররা এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সূচনা করেছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। পরবর্তীকালে প্রতিবছর এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা পশুপাখির প্রতীক ব্যবহার করে, মুখোশ পরিধান করে রংমেখে নানা ধরনের উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে নববর্ষকে বরণ করে। যদিও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে মুসলিম স্কলারদের মধ্যে ভিন্ন মত রয়েছে। অনেকেই এটাকে অন্য ধর্মীয় আচার হিসেবে অভিহিত করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদেরই ছাত্র যুবকরা প্রতিবছর এভাবেই রাজধানী ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা করে নববর্ষকে স্বাগত জানায়। সেই পাকিস্তানি আমল থেকেই রমনার বটমূলে সূর্য উদয়ের সময়ে কবি গুরুর বিখ্যাত ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো” গান গেয়ে আমাদের শিল্পীরা প্রতিবছর পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানায়। এ অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিল ছায়ানট শিল্পী গোষ্ঠী। এ অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে পান্তা-ইলিশ খাওয়া, লাল সাদা পোশাক পরা, কিছু ছেলে মেয়েরা কপালে চন্দন কিংবা টিপ দিয়ে বৈশাখ কে বরণ করে। এসব নিয়ে অবশ্য আলোচনা ও সমালোচনা যথেষ্ট হয়েছে।
গ্রামেগঞ্জে বৈশাখী মেলার মাধ্যমে কুটির শিল্পের বিপণনের একটি সুযোগ এসে যায়, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে জানা গেছে শতকরা ১০ ভাগ আর্থিক কর্মকা- হয়ে থাকে পহেলা বৈশাখ কে কেন্দ্র করে।
পহেলা বৈশাখ আমাদেরকে নিজস্ব কৃষ্টি সংস্কৃতি উদযাপনে উৎসাহিত করে। এদিন আমরা বাংলা সন গণনার মাধ্যমে বাঙালি হিসেবে নিজেদের ঐতিহ্য ও পরিচিতি জানান দেই। আমরা আশা করব আমাদের দেশীয় নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের কিংবা পার্শ্ববর্তী কোন কোন দেশের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে পারব। নির্মল আনন্দের মাধ্যমে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক নববর্ষ কে আমরা বরণ করবো। এই দিনটি উদযাপনের মাধ্যমে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে। যদিও করোনা প্রতিরোধে এ বছরের পহেলা বৈশাখ সবাইকে ঘরেই কাটাতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২২:২০:৫০   ৫৯৮ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

মুক্তমঞ্চ’র আরও খবর


ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতি
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে
আমার দেখা নিউইয়র্ক শহর
মুদ্রাস্ফীতিতে বাংলাদেশ
রোগীর সম্পৃক্ততাই তার নিরাপত্তা
বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের প্রেরণা
বেদনায় ভরা দিন
অর্থনীতিতে নার্সারিশিল্প
এলসি, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও উত্তরণ
উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অপর নাম আওয়ামী লীগ



আর্কাইভ