১৫ আগস্ট: ইতিহাসের কালো অধ্যায়

প্রচ্ছদ » মুক্তমঞ্চ » ১৫ আগস্ট: ইতিহাসের কালো অধ্যায়
শুক্রবার, ১৪ আগস্ট ২০২০



: মোহাম্মদ সেলিম রেজা :

১৫ আগস্ট বাঙ্গালি জাতির কলঙ্কময় শোকের দিন। ১৯৭৫ সালের এদিন ভোরে একদল বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বাঙ্গালি জাতির প্রথম স্বাধীন দেশ, স্বাধীন ভাষা আর সমগ্র বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তরিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর সেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক ও তাঁর সপরিবারকে বুলেটের আঘাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। রাজনীতির সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা না থাকা বঙ্গবন্ধু পরিবারের নারী-শিশুরাও রেহাই পায়নি। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, ভাই শেখ আবু নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিলকে পৈশাচিকভাবে গুলি করে হত্যা করে। মাত্র পনের দিন আগে জার্মানিতে যাওয়ার কারণে ওই চক্রের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব গণমাধ্যমের চোখে ছিলেন এক ঐতিহাসিক ক্ষণজন্মা মহান পুরুষ। তাই অনন্য সাধারণ এ নেতা স্বাধীনতার প্রতীক বা ‘রাজনীতির কবি’ খেতাবেও আখ্যা পেয়েছেন। বিদেশি ভক্ত, কট্টর সমালোচক, এমনকি শত্রুরাও তাদের নিজ নিজ ভাষায় বঙ্গবন্ধুর উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন তার ব্যক্তিত্ববোধ ও নেতৃত্বের। বিগত বিংশ শতাব্দীর জীবন্ত কিংবদন্তি কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখেনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এ মানুষটি ছিলেন হিমালয়ের সমান। সুতরাং হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি।’ প্রসঙ্গত ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্যাস্ট্রোর সাক্ষাৎ হয়েছিল। ফিদেল কাস্ট্রো বলেছিলেন, “শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে”।

---

ভারতের সাবেক ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ এর জাতির পিতার প্রয়াণের খবর শুনে মন্তব্য করেছিলেন, “শেখ মুজিব নিহত হওয়ার খবরে আমি মর্মাহত। তিনি একজন মহান নেতা ছিলেন। তার অনন্য সাধারণ সাহসিকতা এশিয়া ও আফ্রিকার জনগনের জন্য প্রেরণাদায়ক ছিল।” ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি তার সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরকালীন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই উপমহাদেশের গণতন্ত্রের এক প্রতিমূর্তি, এক বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং ভারতের এক মহান বন্ধু ছিলেন।’
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. জিল্লুর রহমান খান ‘বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ঘাতকদের উদ্ধত মেশিনগানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্ভীক উচ্চারণ ছিল ‘যদি বাঙালিরা তাদের জাতির পিতাকে হত্যা করতে চায়, তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু এর পরিণত বাঙালিদের জন্য শুভ হবে না। তাদের জীবন কখনোই আগের মতো হবে না এবং তাকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও তারা হত্যা করবে এবং মানবিকতা বিদায় নেবে।’ [পৃষ্ঠা ২৬১]
সেই কালো রাতে যা ঘটেছিল
বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী (রেসিডেন্ট পি এ) জনাব আ ফ ম মোহিতুল ইসলাম এর এজাহারে বর্ণনানুসারে) ১৯৭৫ সালে তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে কর্মরত ছিলেন। ১৪ আগষ্ট (১৯৭৫) রাত আটটা থেকে ১৫ আগষ্ট সকাল আটটা পর্যন্ত তিনি ডিউটিতে ছিলেন ওই বাড়িতে। ১৪ আগষ্ট রাত বারোটার পর ১৫ আগষ্ট রাত একটায় তিনি তাঁর নির্ধারিত বিছানায় শুতে যান।
মামলার এজাহারে জনাব মোহিতুল উল্লেখ করে বলেন, ‘তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা খেয়াল নেই। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি আমাকে উঠিয়ে (জাগিয়ে তুলে) বলেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে ডাকছেন। তখন সময় ভোর সাড়ে চারটা কী পাঁচটা। চারদিকে আকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ফোনে আমাকে বললেন, সেরনিয়াতের বাসায় দুষ্কৃতকারী আক্রমণ করেছে। আমি জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করলাম। অনেক চেষ্টার পরও পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাইন পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন লাগানোর চেষ্টা করলাম। এরপর বঙ্গবন্ধু ওপর থেকে নিচে নেমে এসে আমার কাছে জানতে চান পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে কেন কেউ ফোন ধরছে না। এসময় আমি ফোন ধরে হ্যালো হ্যালো বলে চিৎকার করছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন আমি প্রেসিডেন্ট বলছি। এসময় দক্ষিণ দিকের জানালা দিয়ে একঝাঁক গুলি এসে ওই কক্ষের দেয়ালে লাগল। তখন অন্য ফোনে চিফ সিকিউরিটি মহিউদ্দিন কথা বলার চেষ্টা করছিলেন। গুলির তান্ডবে কাঁচের আঘাতে আমার ডান হাত দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। এসময় জানালা দিয়ে অনর্গল গুলি আসা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শুয়ে পড়েন। আমিও শুয়ে পড়ি।
কিছুক্ষণ পর সাময়িকভাবে গুলিবর্ষণ বন্ধ হলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ওপর থেকে কাজের ছেলে সেলিম ওরফে আবদুল বঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবী ও চশমা নিয়ে এলো। পাঞ্জাবী ও চশমা পরে বঙ্গবন্ধু বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তিনি (বঙ্গবন্ধু) বললেন আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি এত গুলি চলছে তোমরা কি কর? এসময় শেখ কামাল বলল আর্মি ও পুলিশ ভাই আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। কালো পোশাক পরা একদল লোক এসে শেখ কামালের সামনে দাঁড়ালো। আমি (মোহিতুল) ও ডিএসপি নূরুল ইসলাম খান শেখ কামালের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নুরুল ইসলাম পেছন দিক থেকে টান দিয়ে আমাকে তার অফিস কক্ষে নিয়ে গেল। আমি ওখান থেকে উঁকি দিয়ে বাইরে দেখতে চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি গুলির শব্দ শুনলাম। এসময় শেখ কামাল গুলি খেয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়লেন। কামাল ভাই চিৎকার করে বললেন, আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, ভাই ওদেরকে বলেন।’
মোহিতুল ইসলামের এজাহারের বর্ণনায় বলেন, ‘আক্রমণকারীদের মধ্যে কালো পোশাকধারী ও খাকি পোশাকধারী ছিল। এসময় আবার আমরা গুলির শব্দ শোনার পর দেখি ডিএসপি নূরুল ইসলাম খানের পায়ে গুলি লেগেছে। তখন আমি বুঝতে পারলাম আক্রমণকারীরা আর্মির লোক। হত্যাকান্ডের জন্যই তারা এসেছে। নূরুল ইসলাম যখন আমাদেরকে রুম থেকে বের করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলেন তখন মেজর বজলুল হুদা এসে আমার চুল টেনে ধরলো। বজলুল হুদা আমাদেরকে নিচে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করালো। কিছুক্ষণ পর নিচে থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ শুনলাম। বিকট শব্দে গুলি চলার শব্দ শুনতে পেলাম আমরা। শুনতে পেলাম মেয়েদের আত্মচিৎকার, আহাজারি। এরইমধ্যে শেখ রাসেল ও কাজের মেয়ে রুমাকে নিচে নিয়ে আসা হয়। রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাকে মারবেনাতো। আমি বললাম না তোমাকে কিছু বলবে না। আমার ধারণা ছিল অতটুকু বাচ্চাকে তারা কিছু বলবে না। কিছুক্ষণ পর রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রুমের মধ্যে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর মেজর বজলুল হুদা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মেজর ফারুককে বলে, অল আর ফিনিশড।’
ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে রাসেলকে হত্যার এই নৃশংস বর্ণনা দিয়েছেন। এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার গ্রন্থে লেখেন বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে হত্যার পর রাসেল দৌড়ে নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো বাড়ির কাজের লোকজনের কাছে আশ্রয় নেয়। রাসেলের দীর্ঘকাল দেখাশুনার দায়িত্বে থাকা আবদুর রহমান রমা তখন রাসেলের হাত ধরে রেখেছিলেন। একটু পরেই একজন সৈন্য রাসেলকে বাড়ির বাইরে পাঠানোর কথা বলে রমার কাছ থেকে তাকে নিয়ে নেয়। রাসেল তখন ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে তাকে না মারার জন্য আল্লাহ’র দোহাই দেয়।
জাতির পিতার মৃত্যুতে তাঁর সন্তানদের যেমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর কথা ছিল বাংলাদেশে, তেমনটি সম্ভব হয়নি। হতভম্ব বাঙালি যেন মুষড়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেন। দ্রুত পাল্টাতে থাকে দেশের প্রেক্ষাপট। হঠাৎ করে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। কঠিন এ বাস্তবতার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশের আপামর জনতা প্রস্তুত ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ঢাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে অসংখ্যবার। রাজপথ দাপিয়ে বেড়িয়েছে ঘাতকদের লেলিয়ে দেওয়া সেনাবাহিনী। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টানা ৬৭ দিন বন্ধ থাকার পর পঁচাত্তর সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, মধুর ক্যানটিনসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় পোস্টার ও দেয়াল লিখন হয়েছে। এর আগের রাতেই কলাভবন, সায়েন্স এনেক্স ও কার্জন হলের দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয় ১৫ আগস্ট থেকে ‘নিষিদ্ধ’ তিনটি স্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এবং এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্ররা। ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন ছিল ঘাতকদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ। তৎকালীন ত্রাসের রাজত্বে এসব প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ছিল জাতির জনকের প্রতি মাটির খাঁটি সন্তানের নিঃস্বার্থ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এ কাজে বড় ধরনের ঝুঁকি ছিল। রাতে কারফিউ জারি থাকত এবং সামরিক বাহিনী ও পুলিশ-বিডিআরের গাড়ি টহল দিত ক্যাম্পাসে। গোয়েন্দা তৎপরতা তো ছিলই।
ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশঃ বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক কালো অধ্যায়
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচানোর জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্ব-ঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ (যিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন) ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর আছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর আধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে।
অধ্যাদেশটিতে দু’টি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
এরপর ক্ষমতায় আসেন আর এক সামরিক শাসক মেজর জিয়া। তিনি ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে দেশে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেন।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে যা বলা হয়েছিল, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ ও অন্যান্য আইন, এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোনো ফরমান দ্বারা এই সংবিধানের যে সকল সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে তাহা, এবং অনুরূপ কোনো ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোনো আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে, অথবা অনুরূপ কোনো ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোনো আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোনো দ-াদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত, বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তৎসম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”
তবে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় মতায় আসীন হলে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ উন্মুক্ত করা এবং নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বিচার সম্পন্ন হয়। জোট শাসনের পাঁচ বছর এই রায় কার্যকরের পথে বাধা সৃষ্টি করে রাখা হলেও বর্তমান মহাজোট সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের পাঁচজনের রায় কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। কয়েকজনের ফাঁসি কার্যকর করা হলেও দ- প্রাপ্ত কয়েকজন খুনি বিভিন্ন দেশে পালিয়ে রয়েছেন।
লেখক, ২১ আগস্ট ট্র্যাজেডি ॥ রক্তাক্ত বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সময়: ১৮:০০:৩৮   ১২৩৫ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

মুক্তমঞ্চ’র আরও খবর


ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতি
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে
আমার দেখা নিউইয়র্ক শহর
মুদ্রাস্ফীতিতে বাংলাদেশ
রোগীর সম্পৃক্ততাই তার নিরাপত্তা
বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের প্রেরণা
বেদনায় ভরা দিন
অর্থনীতিতে নার্সারিশিল্প
এলসি, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও উত্তরণ
উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অপর নাম আওয়ামী লীগ



আর্কাইভ