ভোলায় জলবায়ুর দুর্গতদের জন্য গৃহীত প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা

প্রচ্ছদ » জলবায়ু » ভোলায় জলবায়ুর দুর্গতদের জন্য গৃহীত প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা
রবিবার, ২৮ জানুয়ারী ২০২৪



---

মোকাম্মেল মিশু ॥

ভোলায় জলবায়ু তহবিলের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পের বেশির ভাগই জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে আসছে না। অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প গ্রহণের কারণে কোটি কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার ব্যক্ত করেছে ভুক্তভোগীরা। তাদের দাবি, স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিরা এসব প্রকল্পের মাধ্যমে নিজেরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। জলবায়ু তহবিলের অর্থ দিয়ে বাস টার্মিনাল, ডাক বাংলো ও পার্ক তৈরি করে কর্তৃপক্ষ জলবায়ু দুর্গতদের সঙ্গে মশকরা করছে বলে অভিযোগ। জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলা বিভিন্ন উপজেলার দুর্গম চলাঞ্চলের মানুষেরা অথচ প্রকল্পের সুবিধাভোগী হচ্ছে অনেকটা নিরাপদে থাকা শহরের বাসিন্দারা। দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষেরা যে তিমিরে ছিল সে তিমিরই রয়ে গেছে। বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী জলবায়ুর দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলবায়ু তহবিলের অর্থ তসরুফের এই চিত্র।

সদর উপজেলার চর চটকিমার মহিষপালক মোঃ শামসুদ্দিন জানিয়েছেন, চরে দিন দিন লবন পানির পরিমাণ বাড়ছে, বাড়ছে শীতের প্রকোপ। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তাদের মহিষ। এসব কারণে কমে যাচ্ছে ঘাসের উৎপাদন। মহিষ কিংবা গবাদি পশু পালন তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে অথচ এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে নেই কোন প্রকল্প এসব চরে।

ঢাল চরের ইসরাফিল হাওলাদার জানান,গত কয়েক বছর তাদের চরে ফলবতী গাছে কোন পাওয়া যাচ্ছে না। লবণ পানির কারণে গাছগুলো মরে যাচ্ছে। যে কয়টা বেঁচে আছে সেগুলো ফল দিচ্ছে না। কিন্তু এ ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই কারো।

মাঝের চর, চর নিজাম, হাজিপুর, চর জহির উদ্দিন চর মুজাম্মেল, চর নাসরিনসহ একাধিক চরের বাসিন্দারা বলছেন, নদী ভাঙ্গন এখন তাদের নিত্য সঙ্গী। এইসব চর ছাড়া মূল ভূখ-ও প্রতিনিয়ত ভাঙ্গনের কবলে পড়ছে। হাজার হাজার মানুষ বাস্তুভিটা হারা ও ভূমিহীন হয়ে পড়ছে।শহরের বস্তিতে গিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদেরকে পুনর্বাসন করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্বীপজেলা ভোলা প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত। এখানে বাস করছে ২২ লাখ মানুষ। এদের মধ্যকার পাঁচ লাখ মানুষ বসবাস করছে ছোট ছোট দ্বীপ চরে। এসব মানুষের কল্যাণে কোন প্রকল্প নেই।

এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয় নেয়ার মত প্রয়োজনীয় আশ্রয় কেন্দ্র বা কিল্লাও নেই চরগুলোতে। স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে চর বাসি । অনেক চরে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র না থাকায় বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে তারা। বেশী সমস্যায় পড়ছে প্রসূতি মায়েরা, গর্ভকালীন পরামর্শ পায় না তারা। আর্থিক সংকটের কারণে শহরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারে না। টলার বা স্পিড বোটে করে শহরে যাওয়ার পথে অনেকে সন্তান প্রসব করে। এ সময় বহুরোগী মারা যায়।

চরাঞ্চল গুলোতে মানুষ এ ধরনের হাজারো সমস্যা নিয়ে থাকেন কিন্তু সমস্যার সমাধানে কোন প্রকল্প গৃহীত হয় না। এসব চরে কিভাবে মানুষ খাপ খাইয়ে অভিযোজন ক্ষমতা বাড়িয়ে টিকে থাকবেন সে বিষয়ে প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য আন্তর্জাতিক মহল জলবায়ু তহবিলে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় অথচ এসব টাকার নামমাত্র প্রকল্পে কিংবা অপরিকল্পিত অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের এমন একটি প্রকল্প হচ্ছে চরফ্যাশনের জলবায়ু সহিষ্ণু ডাকবাংলো। যেখানে সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এবং পর্যটকরা এসে বিশ্রাম নেন। সেখানে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।

চরফেশনে ২৪ কোটি টাকায় তৈরি করা হয়েছে পর্যটন স্পট জ্যাকব টাওয়ার। তার অর্ধেকের বেশি টাকা এসেছে জলবায়ু তহবিল থেকে। চরফ্যাশনে বাস টার্মিনাল হয়েছে এ তহবিলের অর্থে ব্যয় হয়েছে ৮ কোটি টাকা। এছাড়া কুকরী-মুকরীতে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। যাতে ধোনির সন্তানের গিয়ে বিনোদন করে থাকে। অথচ এখানকার জীববৈচিত্র সংরক্ষণ জরুরী কিন্তু তাতে কোন প্রকল্প নেই। কুকরীমুকরীসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে বৃক্ষরাজির যে নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে, যা বিভিন্ন দুর্যোগে ভোলা ও ভোলা বাসিকে রক্ষায় ঢাল হিসেবে কাজ করে সে নিরাপত্তা বেষ্টনীর গাছগুলো মরে যাচ্ছে। তার প্রতিকারেও কোন প্রকল্প নেই জলবায়ুর তহবিল থেকে। এ বিষয়ে ভোলার পরিবেশবাদী আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট নজরুল হক সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, দ্বীপ জেলা ভোলায় লক্ষাধিক একর জমিতে কয়েক কোটি গাছ রয়েছে সরকারিভাবে। বেসরকারিভাবেও বিভিন্ন জায়গা বৃক্ষরাজি দ্বারা আচ্ছাদিত আছে। দেশের অন্তত ২৫ ভাগ এলাকায় বনায়ণ থাকা দরকার। ভোলায় ৩৪ ভাগ এলাকায় বনায়ণ রয়েছে। এসব বন প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করে আসছে। সারা বিশ্ব এতে উপকৃত হচ্ছে। আমাদের ভোলা যে পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করে যাচ্ছে জলবায়ু তহবিল থেকে সে পরিমাণ বরাদ্দ ভোলায় আসছে না। পর্যাপ্ত বরাদ্দ পেলে জলবায়ুর দুর্গতদের জন্য অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা যেত।

---

এ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ ভোলার নির্বাহী প্রকৌশলী এ. এস. এম. মুসা জানান, সরকারের উচ্চ মহল থেকে এসব প্রকল্পগুলোর অনুমোদ আসছে। নিশ্চয়ই প্রকল্পগুলো জলবায়ু দুরগতদের কল্যাণে তৈরি করা হয়েছে। এ ধরনের আরো প্রকল্প ভোলায় বাস্তবায়ন করা দরকার। ভোলার সকল মানুষই জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছেন। সুতরাং ভোলার সকল প্রকল্পই তাদের জন্য কল্যাণকর বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এদিকে জলবায়ু দুর্গতদের পুনর্বাসনের জন্য ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে ক্লাইমেট ভিকটিম রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট (সিভিআরপি)’র মাধ্যমে ২০১৬ থেকে ২০২১ সালে অন্তত ১ শত ১২ গুচ্ছগ্রামের সাড়ে পাঁচ হাজার ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ২ শত ৬ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ টাকায় জলবায়ুর্গতরা পুনর্বাসিত হননি বরং দুর্গত মানুষরা দুর্গম চরাঞ্চলে নির্বাসিত হয়েছেন। চরাঞ্চলের গুচ্ছগ্রামগুলোতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও নিরাপত্তা মূলক ব্যবস্থা না থাকায় মানুষরা সেখানে যাননি। দু’একজন গেলেও তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

ভোলার মাঝের চর, দৌলতখানের হাজিপুর, মদনপুর, নেয়ামতপুর, চরফ্যাশনের চর নিজাম, চর জাহান, চর হাসিনা, ঢালচর, চর পাতিলা, লালমোহনের চর কচুয়াখালী, তজুমদ্দিনের চর মোজাম্মেলসহ চরের গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তাদের আশ্রয় নেয়ার জন্য কোন আশ্রয় কেন্দ্র নেই। এমনকি তাদের গবাদি পশু রাখার জন্য উঁচু জায়গাও নেই চরগুলোতে। রাস্তা না থাকায় চলাফেরাও করতে পারছে না গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামগুলোতে বেশিরভাগ ঘরই মানুষ না থাকায় বিনা ব্যবহারে জীর্ণশীর্ণ হয়েছে।

---

কোন কোন গুচ্ছগ্রাম বিনষ্ট হয়ে গেছে। অনেকগুলো আবার নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া যেগুলো আছে তার অধিকাংশ ঘরেই মানুষের পরিবর্তে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলসহ গবাদি পশু পালন করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের দূরদর্শিতার অভাবের কারণে গুচ্ছগ্রামগুলো জলবায়ুর দুর্গতদেরকল্যাণে আসেনি, শুধু অর্থের অপচয় ঘটেছে মাত্র। গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের ঘর গুলো করার সময় স্থানীয় প্রশাসন বিশেষ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার ভূমি এবং গুচ্ছগ্রামের মালামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিদের জোকসাজশে নি¤œমানের ঘর তৈরি করেছেন। এমনকি ঘরের নকসা পরিবর্তন করেছেন। নি¤œমানের টিন দিয়েছেন, ঘরের মেঝের মাটি পর্যন্ত দেয়া হয়নি। ঘরগুলো ছিলো স¤পূর্ণ বসবাস অযোগ্য। ফলে ঘরগুলোতে বসতি গড়ে ওঠেনি। শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পকেট ভারী হয়েছে। অর্থাৎ অপচয় হয়েছে জলবায়ু প্রকল্পের অর্থ।

বাংলাদেশ সময়: ০:৪৮:২০   ১৯৭ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

জলবায়ু’র আরও খবর


ভোলায় জলবায়ুর দুর্গতদের জন্য গৃহীত প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা
ভোলায় দুর্যোগ ঝূঁকি ও প্রস্তুতিতে কমিউনিটি লিডারদের সক্ষমতাবৃদ্ধির লক্ষে প্রশিক্ষণ
উপকূল দিবসের দাবীতে সমাবেশ
উপকূল দিবসের দাবীতে সমাবেশ
বোরহানউদ্দিনে গ্লোবাল ডে অব ক্লাইমেট অ্যাকশন উপলক্ষে আলোচনাসভা মানববন্ধন ও র‌্যালি
ভোলায় প্রকৃতি ও জীবন ক্লাবের উদ্যোগে ব্যাংকেহাটে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ রোপন
ভোলায় কমিউনিটি অপারেশন ম্যানুয়ালের উপর প্রশিক্ষণ কর্মশালার শুভ উদ্বোধন
ভোলায় স্বেচ্ছাসেবক ফাউন্ডেশনের আয়োজনে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত
ভোলায় নানা আয়োজনে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত
ভোলায় বিশ^ পরিবেশ দিবসে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি



আর্কাইভ