আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর ॥ ইতিহাসের শোকাবহ দিন পালিত হবে “উপকূল দিবস”

প্রচ্ছদ » জাতীয় » আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর ॥ ইতিহাসের শোকাবহ দিন পালিত হবে “উপকূল দিবস”
শনিবার, ১১ নভেম্বর ২০১৭



---
শিমুল চৌধুরী ॥
আজ শনিবার সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর। ইতিহাসের এক শোকাবহ দিন। উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলাবাসীর বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের দিন আজ। ১৯৭০ এর এ দিনে উপকূলবাসীর জীবনে নেমে এসেছিল এক মহাদুর্যোগ। প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় গোর্কী ও জলচ্ছ্বাসে লন্ড-ভন্ড করে দেয় উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলা। ওই দিন পুরো জেলা ধ্বংস লীলায় পরিনত হয়েছিল। মুহুর্তের মধ্যেই ক্ষত বিক্ষত করে দেয় জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ। ১২ নম্বর মহা বিপদ সংকেতের সামুদ্রিক জলচ্ছ্বাসে ও মহা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় নিমিষেই তলিয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় চরাঞ্চলের বাড়ি-ঘর এবং মাঠের সোনালী ফসল। স্রোতের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ ও গবাদি পশু। পুরো উপকূল যেন বিরান ভূমিতে পরিনত হয়েছিল। জলচ্ছ্বাসের পর থেকে দেড় মাস পর্যন্ত স্বজন হারানোদের কান্নায় উপকূলের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠেছিল। স্বাধীনতার পর এ যাবৎ যে কয়টি ঘুর্নিঝড় হয়েছে তার মধ্যে ৭০ এর বন্যাটি সব চেয়ে ভয়াবহ ও হিংস্র ছিল বলে মনে করছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। ৭০ এর হ্যারিকেনরুপী জলচ্ছ্বাসের সময় ঝড়টি উপকূলীয় দ্বীপ জেলা ভোলা, লক্ষ্মীপুর, হাতিয়া, সন্দ্বীপ বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়াও পাশ্ববর্তী বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনাসহ দক্ষিনাঞ্চলের প্রায় ১৮টি জেলায় আঘাত হানে।
উপকুলীয় জেলাগুলোর মধ্যে বেশী ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল দ্বীপ জেলা ভোলায়। তৎকালীন সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি অনেকটা দুর্বল থাকায় উপকুলের বহু মানুষ ঝড়ের পূর্বাভাস পাননি। এ সময় জলচ্ছ্বাস হয়েছিল ১০ থেকে ১৪ ফুট উচ্চতায়। কেউ গাছের ডালে, কেউ আবার উঁচু ছাদে আশ্রয় নিয়ে কোনমতে প্রানে রক্ষা পেলেও ৩/৪ দিন পর্যন্ত তাদের অভুক্ত কাটাতে হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই সময় ভোলার এক তৃতীয়াংশ জনপদ লন্ড-ভন্ড হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর এক এক করে ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও কান্না থামেনি উপকূলীয় এলাকার স্বজন হারা লাখো মানুষের। এদিকে নিহতদের স্মরনে উপকূলীয় জেলাগুলোতে পালন করা হবে স্মরনসভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। এ ছাড়া এই প্রথমবারের মত উপকূল দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উপকূলীয় এলাকার মানুষ। উপকূল সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টুর আহ্বানে ভোলা জেলার ভোলা সদর, মনপুরা, তজুমদ্দিন উপজেলা এবং বরগুনা জেলাসহ উপকূলীয় কয়েকটি জেলায় উপকূল দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৭০ এর ঘূর্ণিঝড় একটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় উল্লেখ করে ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাং সেলিম উদ্দিন বলেন, তখন এ জেলায় বহু মানুষ ও গবাদি পশু-পাখির মৃত্যু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময়ে বিধ্বস্ত এ জেলা পরিদর্শন করেছিলেন। কিন্তু এখন ভোলার উপকূল ও চরাঞ্চলের উন্নয়নে ব্যাপক কাজ হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় বর্তমানে বাংলাদেশ একটি মডেল হয়েছে।
এ বিষয়ে উপকূলের সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম মন্টু বলেন, উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়নসহ উপকূল সুরক্ষার লক্ষ্য সামনে রেখে এবার দেশে প্রথমবারের মত ‘উপকূল দিবস’ পালিত হচ্ছে। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিন উপকূলের ৩৪ স্থানে একযোগে ‘উপকূল দিবস’ পালিত হবে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে র‌্যালী, আলোচনা সভা এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দাবি সম্মলিত স্মারকলিপি পেশ। উপকূলবর্তী ১৫ জেলার ৩২ উপজেলার ৩৪ স্থানের দিবসটি পালিত হবে। উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের সদর, রায়পুর; ভোলা জেলার সদর, চরফ্যাসন, তজুমদ্দিন, মনপুরা; পটুয়াখালীর সদর, গলাচিপা, বাউফল, কলাপাড়া, কুয়াকাটা, রাঙ্গাবালী, নীলগঞ্জ (কলাপাড়া); চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ; ফেনীর সোনাগাজী, ছাগলনাইয়া; সাতক্ষীরার সদর, তালা, শ্যামনগর, বুড়িগোয়ালিনী (শ্যামনগর); খুলনার পাইকগাছা; বরিশাল সদর; চাঁদপুর সদর; পিরোজপুরের কাউখালী; নোয়াখালীর সুবর্ণচর, হাতিয়া; বরগুনার সদর, পরীরখাল (বরগুনা সদর); বাগেরহাটের সদর, শরণখোলা; কক্সবাজারের টেকনাফ, সেন্টমার্টিন; এবং ঝালকাঠির সদর ও কাঁঠালিয়ায় দিবসটি পালিত হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, উপকূল দিবস বাস্তবায়ন কমিটির আহবানে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের প্রায় ১০০ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান দিবস পালনে এগিয়ে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, গণমাধ্যকর্মীদের সংগঠণ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠণ, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, কিশোর-তরুণদের ফোরাম ইত্যাদি। দিবস পালনের প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উপকূল বাংলাদেশ, কোস্টাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ, আলোকযাত্রা দল। এত দিবসের ভিড়ে উপকূলের জন্য একটি পৃথক দিবস প্রসঙ্গে উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্তরা বলেন, উপকূলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমূখী দুর্যোগের সঙ্গে বসবাস করেন। কেবল দুর্যোগ এলেই এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খবরাখবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও তাদের জীবন যে কতটা অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে খুব একটা খোঁজ রাখা হয়না। উপকূলের দিকে গণমাধ্যম ও নীতিনির্ধারকদের নজর বাড়িয়ে উপকূলবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ঘটানোই উপকূলের জন্য একটি দিবস প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। ১২ নভেম্বর ‘উপকূল দিবস’ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে উদ্যোক্তারা আরো বলেন, দিবস বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ১২ নভেম্বরকে বেছে নেওয়ার কারণ হচ্ছে, ১৯৭০ সালের এ দিনটি উপকূলবাসীর জন্য স্মরণীয় দিন। এদিন বাংলাদেশের উপকূলের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘ভোলা সাইকোন’। এ ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দেয় উপকূল। বহু মানুষ প্রাণ হারান। ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন। এ ঘূর্ণিঝড় গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এটি সিম্পসন স্কেলে ক্যাটাগরি ৩ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় ছিল। ঘূর্ণিঝড়টি ৮ নভেম্বর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট হয়। ক্রমশ শক্তিশালী হতে হতে এটি উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১১ নভেম্বর এটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছায়। ওই রাতেই উপকূলে আঘাত হানে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপসমূহ প্লাবিত হয়। ওই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটেছে বলে বলা হলেও বেসরকারি হিসেবে প্রায় দশ লাখ।
জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) বিশ্বের পাঁচ ধরনের ভয়াবহ প্রাণঘাতি আবহাওয়া ঘটনার শীর্ষ তালিকা প্রকাশ করে চলতি বছরের ১৮ মে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টিকে পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণঘাতি ঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে উইকিপিডিয়ার সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত রেকর্ডকৃত ঘূর্ণিঝড় সমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্নিঝড়।

বাংলাদেশ সময়: ২২:০৮:৩৮   ৫৮৬ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

জাতীয়’র আরও খবর


শ্রেষ্ঠ মাদ্রাসা অধ্যক্ষ নির্বাচিত হলেন মুফতি মাও: মুজির উদ্দিন
সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোলায় সমাবেশ
অচিরেই ভারতের তাঁবেদার শেখ হাসিনার দুঃশাসন দূর হবে: তারেক রহমান
৫১১ রানের টার্গেট তাড়ায় ৩৭-এ ৫ উইকেট হারাল বাংলাদেশ
ভারতের আনুগত্য নিয়ে দেশ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ: হাফিজ উদ্দিন
আমাকে অ্যাপ্রোচ করেছিল, আমি গ্রহণ করিনি: মেজর অব. হাফিজ
শান্ত-মুশফিকের রেকর্ড জুটিতে দাপুটে জয় বাংলাদেশের
অষ্ট্রেলিয়া ডে পুরষ্কার পেলেন নেহাল নাফসি রুপাই
আজ ভোলায় আসছেন শিল্পমন্ত্রী ও বিদ্যুৎ জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী
এখন দেখার বিষয় ইউরোপ আমেরিকা কী কার্ড ফেলে: ব্যারিস্টার পার্থ



আর্কাইভ