
বিশেষ প্রতিনিধি ॥
ভোলার দৌলতখান ভূমি অফিসে নাজির-পেশকার মিলে গড়ে তুলেছেন ঘুসের সিন্ডিকেট। এর মধ্যে পেশকার আবদুল খালেকের ঘুস নেওয়ার একটি ভিডিও বুধবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি নিয়ে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। জানা গেছে, পেশকার আবদুল খালেক ২০১৫ সাল থেকেই এ অফিসে কর্মরত আছেন। তার সহযোগী নাজির আনোয়ার হোসেন আছেন ২০০৪ সাল থেকে। একই অফিসে বছরের পর বছর চাকরি করার সুবাদে তাদের নিয়ন্ত্রণে অফিসকেন্দ্রিক গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নামজারি থেকে শুরু করে জমি সংক্রান্ত যে কোনো কাজে মোটা অঙ্কের ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। একেকটি নামজারিতে ৬ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয় তাদেরকে। সক্রিয় এ সিন্ডিকেটের কারণে নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেবা নিতে আশা সাধারণ মানুষ। বুধবার ফেসবুকে ছড়িয়ে ৫ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, একজন নারী এক হাজার টাকার ৩-৪টি নোট পেশকার আব্দুল খালেকের হাতে দেন। আব্দুল খালেক টাকাগুলো হাতে নিয়ে গুনছেন।
তবে ভিডিওটিতে আবদুল খালেকের চেহারা দেখা গেলেও ওই নারীর চেহারা দেখা যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টাকা দেওয়া ওই নারীর নাম শাহনাজ। তিনি দৌলতখানের হাজিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। গত রোববার তিনি নামজারির জন্য ভূমি অফিসে এসে আব্দুল খালেককে ওই টাকা দিয়েছেন। সম্প্রতি সরেজমিন দৌলতখান উপজেলা ভূমি অফিসে তিন-চারজন লোক পেশকার আবদুল খালেকের টেবিলের সামনে বসে থাকতে দেখা যায়। আবদুল খালেক ছিলেন পাশের রুমে। এ সময় পরিচয় গোপন রেখে কথা হয় খালেকের টেবিলের সামনে বসা শহীদুল ইসলাম নামের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘অফিসের মধ্যে আব্দুল খালেক খুব ভালো লোক। তাকে দিয়ে নামজারি করালে কোনো ঝামেলা নেই। এর আগেও আবদুল খালেকের মাধ্যমে তিনি ২৫ হাজার টাকা দিয়ে দুইটি নামজারি করিয়ে নিয়েছেন। ২৫ হাজার টাকায় আরও দুইটি নামজারি করতে দিয়েছেন। একটি দলিল কম থাকায় সেটি দেওয়ার জন্য এসেছেন। আবদুল খালেক অফিসে বসেই আবেদন করে দিয়েছেন।’
শহীদুল ইসলাম আরও জানান, ‘আগে নাজির আনোয়ারের মাধ্যমে নামজারির কাজ করাতেন। তিনি টাকা বেশি নেওয়ায় এখন খালেকের মাধ্যমে কাজ করিয়ে থাকেন। খালেক জুনিয়র হলেও কাজ খুব ভালো করেন।’ পরে খবর নিয়ে জানা যায়, শহীদুল ইসলাম ওই ভূমি অফিসের দালাল চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য।
২০২২ সালের নভেম্বরে দৌলতখান উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম খান ও স্থানীয় মোখলেছুর রহমান গংদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধের বিষয়ে ভূমি অফিসে তদন্তে যান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. রায়হান উজ্জামান। তদন্ত শেষ করে তিনি চলে আসার পর নাজির আনোয়ার উপজেলা চেয়ারম্যানের পক্ষ নিয়ে মোখলেছুরের বোন ফিরোজা খাতুন ও তার ছেলে আব্দুর রবকে মারধর করেন। বিষয়টি নিয়ে তারা তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছে মারধরের ভিডিও ফুটেজসহ অভিযোগ দিলে নাজির আনোয়ারকে মনপুরায় বদলি করা হয়। কিন্তু বদলির কয়েক মাস পরই মনপুরা থেকে চলে আসেন। মো. মোখলেছুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, তাদের পৈতৃক ও ক্রয়কৃত দুই একর ২০ শতাংশ জমি কয়েক যুগ ধরে ভোগদখল করে আসছেন। ওই জমি ২০০৯ সালে নাজির আনোয়ার হোসেনের যোগসাজশে উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম খানের নামে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে নামজারি করেন। নুরে আলম নামের এক সেবাগ্রহীতা জানান, তিনি দুই মাস আগে নাজির আনোয়ারকে একটি নামজারির করার জন্য ৬ হাজার টাকা দিয়েছেন।
এর আগেও আনোয়ারকে টাকা দিয়ে তিনি নামজারি করিয়ে নিয়েছেন। এ দিকে, গত এপ্রিল মাসে দৌলতখান উপজেলা ভূমি অফিস পরিদর্শন করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. রাজিবুল ইসলাম একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। সেখানে পরিদর্শনকালীন পরামর্শ কলামের প্রথমেই তিনি উল্লেখ করেন, পরিদর্শনকালীন ভূমি অফিসের ভিপি রেজিস্টারের বিভিন্ন পাতায় ওভার রাইটিং ও ফ্লুইড ব্যবহার দেখতে পেয়েছেন। রেকর্ড রুমের নথিসমূহ এলোমেলো এবং যত্রতত্র রয়েছে। রেকর্ডরুমের দায়িত্বপালনকারী কর্মচারী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশ প্রদান করেন তিনি। জানতে চাইলে পেশকার আবদুল খালেক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি কোনো নামজারির টাকা নেই না। একটি মহল ষড়যন্ত্র করে ফেসবুকে ভিডিও ছড়িয়েছে। নাজির আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি অফিসের সামনে কাউকে মারধর করেননি। তবে কথা কাটাকাটি হয়েছে। আর নামজারিতে তিনি কারও কাছ থেকে কোনো টাকা নেননি। সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুন্নী ইসলাম জানান, আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ায় তাকে শোকজ করা হয়েছে। আর আনোয়ারের বিরুদ্ধে এখনো লিখিত অভিযোগ বা প্রমাণ পাননি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বলেন, অভিযুক্ত নাজির ও পেশকারের বিরুদ্ধে তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৪০:৪০ ৮৩ বার পঠিত