বিশেষ প্রতিনিধি ॥
গৃহবধূ মোসা. সেলিনা বেগম। ৬ কন্যাসন্তানের জননী তিনি। প্রায় তিন বছর আগে ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তার স্বামী মো. খোরশেদ আলম। এরপর থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রাম। সংসারে উপার্জনকারী অন্য কেউ না থাকায় স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসার হাল ধরেন গৃহবধূ সেলিনা বেগম।
পুরুষশাসিত এ দেশের সমাজে এই চিত্র খুবই কম। তবে সেলিনা বেগম স¤পূর্ণ ব্যতিক্রম। বর্তমানে তিনি স্বামীর রেখে যাওয়া ইট, বালু, সিমেন্ট আর হার্ডওয়ারের ব্যবসাটি পরিচালনা করছেন। নারী হয়েও অত্যন্ত দক্ষভাবে ভোলার লালমোহন উপজেলার বদরপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকা দেবীরচর বাজারের ব্রিজ সংলগ্নস্থানে সেলিনা বেগম তার ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তিনি বদরপুর ইউনিয়নের ২নম্বর ওয়ার্ডের দেবীরচর এলাকার মেলকার বাড়ির মৃত মো. খোরশেদ আলম মেলকারের স্ত্রী।
গৃহবধূ সেলিনা বেগম বলেন, আমার স্বামী প্রায় ১৫ বছর আগে মেসার্স মা ট্রেডার্স নামে এই ব্যবসাটি শুরু করেন। এখানে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট এবং হার্ডওয়ারের মালামাল রয়েছে। ব্যবসা শুরুর ৯ বছর পর আমার স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার দেখানোর পর তার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। অর্জিত যত অর্থ ছিল তা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা চলছিল। তবে করোনাকালে ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে না পেরে প্রচ- অসুস্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত মারাই যান তিনি।
তিনি আরো বলেন, আমার স্বামীর চিকিৎসার পেছনে প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ হয়। আমাদের ৬ কন্যাসন্তান। বড় মেয়েকে তিনি জীবিত থাকতেই বিয়ে দিয়ে গেছেন। তার মৃত্যুর সময় ছোট মেয়ের বয়স ছিল মাত্র ৬ মাস। স্বামীর মৃত্যুর পর ৫ মেয়েকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়ি। তখন ভাবতে থাকি ছোট ছোট মেয়েদের নিয়ে আমি কোথায় যাবো, কি করবো? তাছাড়া বাড়িতে ঘর ভিটা আর এই ব্যবসা ছাড়া কোনো স¤পদ নেই আমাদের। এই গ্রাম্য এলাকায় কোনো নারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন না। তবে মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিই স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি নিজেই পরিচালনা করার। সেই ভাবনা থেকে নিজেই এখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছি। এই গ্রাম্য এলাকায় মহিলা হয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে প্রথমে কিছুটা সমস্যা হতো। তবে এখন সবকিছুই সুন্দরভাবে পরিচালনা করছি।
তিনি জানান, আমার দোকানে ইট, টোক বালি, সিমেন্ট, রড, পানির কল, রঙ ও সকল প্রকার হার্ডওয়ারের মালামাল পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করি। মৌসুমের সময় প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারি। এখন অফ সিজন চলছে। তাই বেচাকেনাও কম। মাস দুইয়েক পর আবার মৌসুম শুরু হবে। এই দোকান থেকে বছর শেষে প্রায় ৪ লাখ টাকার মতো আয় হয়। তবে সেই টাকা একজন ম্যানজার, ট্রাক ড্রাইভারসহ কয়েকজন দিনমজুর এবং সংসারের পেছনে খরচ হয়ে যায়। আমার ৪ মেয়ে পড়ালেখা করে। ছোট একজনের বয়স এখন মাত্র সাড়ে ৩ বছর। যার জন্য তাকে এখনো স্কুলে ভর্তি করাইনি। বছর শেষে যা আয় হয় তা আবার সবকিছু মিলিয়ে খরচও হয়ে যায়। সঞ্চয় করতে পারি না কিছুই।
গৃহবধূ সেলিনা বেগম আরো জানান, স্বামীর অসুস্থতায় ব্যবসার অনেক টাকা ব্যয় হওয়ায় বর্তমানে ব্যবসাটি পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন এনজিও থেকে কয়েক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। বর্তমানে ব্যবসাটি ছোট হওয়ায় তেমন মালামাল তুলতে পারছি না। ব্যবসাটি আরো সম্প্রসারণ করার আগ্রহ রয়েছে। তবে সেজন্য অনেক টাকা পুঁজি দরকার। কোনো প্রতিষ্ঠান বা সরকারিভাবে ব্যবসায়িক ঋণ প্রদান করলে ব্যবসাটি আরো সম্প্রসারণ করতে পারবো। তাতে বেচাকেনাও বাড়বে আর আয়ও বাড়বে। আয় বাড়লে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে পারবো। যা মেয়েদের ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারবো।
এ বিষয়ে লালমোহন উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কানিজ মার্জিয়া বলেন, ওই নারীর ব্যাপারে আমাদের আগে জানা ছিল না। এখন জেনেছি, তবে আমাদের কার্যালয় থেকে তাকে আর্থিক অনুদান প্রদানের সুযোগ নেই। তবে তিনি যেহেতু একজন সংগ্রাম নারী তাকে আমরা জয়িতা পুরস্কার প্রদানের চেষ্টা করবো।
লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক অনুদান প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু তিনি ব্যবসা করেন, সেক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যাংকগুলোতে যোগাযোগ করলে ঋণ পেতে পারেন। যা তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সম্প্রসারণে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১:৪৯:৫৫ ১৩১ বার পঠিত