বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪

নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান কতটুকু উপকারে আসছে

প্রচ্ছদ » অর্থনীতি » নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান কতটুকু উপকারে আসছে
সোমবার, ২২ মে ২০২৩



বিশেষ প্রতিনিধি ॥

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে একাধিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা এলেও দেশটিতে গ্যাসের সংকট তাতে কমেনি, বরং আরো বেড়েছে। এমনকি বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করেও সংকট সামলানো যাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতীতে জ্বালানি নিয়ে সরকারের নেয়া ভুল নীতির কারণেই এখন গ্যাস নিয়ে এই সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

তবে কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হলেও সেগুলো উত্তোলন প্রক্রিয়ায় যেতে সময় লাগায় পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সোমবার (২২ মে) ভোলায় নতুন একটি গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে সরকার।

ভোলায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারঃ

সোমবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ স¤পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ভোলায় ইলিশা-১ নামের নতুন একটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে, যেখানে ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ২৬ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত এখানে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এটি দেশের ২৯তম গ্যাস ক্ষেত্র।

---

কিন্তু দেশে চলমান গ্যাস সংকট সমাধানে ভোলার এই গ্যাস আপাতত কোনো সমাধান আনতে পারছে না। কারণ পাইপলাইন না থাকার কারণে ভোলার বাইরে এই গ্যাস সরবরাহ করা যাবে না। ভোলা জেলায় এ পর্যন্ত ৯টি কূপে ১.৭ ট্রিলিয়ন গ্যাস মজুদের বিষয়টি নিশ্চিত হলেও জাতীয় গ্রিডে নেয়া সম্ভব হয়নি।

এমনকি ভোলাতেই অন্য দুটি গ্যাসক্ষেত্রে থেকে দৈনিক ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও সেখানে গ্যাস ব্যবহার করা যাচ্ছে সর্বোচ্চ ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এই দ্বীপ জেলা থেকে সিলিন্ডারে সিএনজি আকারে দেশের অন্যত্র গ্যাস আনার পরিকল্পনা করা হলেও তার পরিমাণ খুব সামান্য।

‘পাইপলাইন বসিয়ে ভোলার আবিষ্কার হওয়া গ্যাস দেশের মূল গ্রিডে নিয়ে আসতে সময় লাগবে। এ নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে, আশা করি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত হবে। আসলে ভোলা এলাকাটা নদী সংকুল হওয়ায় পাইপলাইন বসানো খুব সোজা না। অন্য জায়গায় পাইপলাইন দুই-তিন বছরের মধ্যে বসানো গেলেও এখানে প্রকল্প নেয়ার পরে চার পাঁচ বছর লেগে যাবে’, বলেন তিনি।

গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হচ্ছে, কিন্তু গ্যাসের সংকট কবে যাবে?

বাংলাদেশে বর্তমানে মোট গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে ২৯টি, যার মধ্যে ১৯টি থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে। দেশের মজুদ থেকে প্রতিবছর এক টিসিএফ করে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। কিন্তু সেই হারে নতুন গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া যাচ্ছে না।

পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, এসব গ্যাস ক্ষেত্রে মোট মজুদ ছিল প্রায় ৩০.৮৩ টিসিএফ গ্যাস। এই মজুদের তালিকায় ১৯৬৫ সালে আবিষ্কৃত যেসব গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, তাদের মজুদের হিসাবও রয়েছে। সেখান থেকে এতদিন পর্যন্ত ১৯.৯৪ টিসিএফের বেশি গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। গ্যাস উত্তোলনের পর বর্তমানে মজুদ রয়েছে ৮.৬৮ টিসিএফ গ্যাস।

বিদ্যুৎ, সার কারখানা, আবাসিক, পরিবহন খাতে ব্যবহারের কারণে এই মজুদও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কর্মকর্তাদের আশঙ্কা বড় ধরনের মজুদ পাওয়া না গেলে আগামী আট থেকে ১০ বছরের মধ্যে দেশের গ্যাস ফুরিয়ে যাবে।

বাংলাদেশে এখন গ্যাসের চাহিদা দৈনিক প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে সরকার এখন পর্যন্ত দৈনিক সরবরাহ করে ৩০০ কোটি ঘনফুট। এই গ্যাসের মধ্যে দেশীয় উৎপাদন প্রতিদিন ২৩০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা আমদানি করা লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি দিয়ে মেটানো হয়।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমাদের যে পরিমাণ গ্যাসক্ষেত্র আছে, সেখান থেকে প্রতিদিন আমরা ২২০০/২৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমরা সরবরাহ করছি। আমাদের যতটুকু চাহিদা আছে, তাতে শুধু একটা গ্যাসক্ষেত্র সেখানে আসলে বিশাল কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারে না। যদি কোনো এলাকায় আমরা বিপুল পরিমাণে গ্যাস পাই, সেটা হয়তো কাজে আসতে পারে, না হলে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হবে।’

পুরনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে আগে যে পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যেতো, এখন সেটা অনেক কমে এসেছে বলে তিনি জানান।

কর্মকর্তারা বলছেন, পুরনো গ্যাস ক্ষেত্র থেকে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস পাওয়ার পরিমাণ কমে গেছে। কিন্তু গ্যাসের চাহিদা ২০ বছর আগের তুলনায় তিনগুণ বেড়ে গেছে। সেই অনুযায়ী নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার বা উৎপাদন হয়নি।

দেশে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন খাত ও অনেক শিল্প, কলকারখানা গড়ে ওঠে। ২০০১ সালের পর দেশে রাতারাতি গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। বিইআরসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জ্বালানি খাতের প্রায় ৪৬ শতাংশ গ্যাস খাত থেকে সরবরাহ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেলে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর পরিবর্তে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করে নিয়ে আসার নীতি নিয়েছিল বাংলাদেশের সরকার। কারণ তখন দেশে অনুসন্ধান বা উৎপাদনের জন্য কূপ খননের চেয়ে আমদানি করাকে বেশি লাভজনক বলে মনে করা হয়েছিল।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, আশির দশকে যখন অনেক গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া গেল, তখন এমন অবস্থা ছিল যে, আপনার অনেক গ্যাস আছে, কিন্তু চাহিদা ততটা নেই। ফলে এরপর আর গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি।‘

তিনি বলেন, ‘যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কার হয়েছে, সেগুলো হয়তো বিরাট বড় না। কিন্তু সম্মিলিতভাবে সেটার আকার ভালো। কিন্তু এগুলোর উন্নয়ন করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া উচিত, সেটা নেয়া হচ্ছে না। কারণ কর্তৃপক্ষের হয়তো ধারণা তৈরি হয়েছে, বাংলাদেশে বুঝি গ্যাস আর নেই, শেষ হয়ে গেছে।’

‘এটার কারণেই গ্যাস উত্তোলন এবং আহরণের জন্য যে চেষ্টা বা আগ্রহ থাকা উচিত ছিল, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তার চেয়ে আমদানি নির্ভরতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এর কারণে দেশীয় গ্যাসের আবিষ্কার এবং উত্তোলনটা পিছিয়ে পড়েছে,’ বলেন তিনি।

কী করছে কর্তৃপক্ষ?

দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে যে পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে, তা দিয়ে চাহিদার পুরোটা মেটানো যায় না। এই সরবরাহের ৬০ শতাংশ, প্রায় ২১৭ কোটি ঘনফুট আসে শেভরনের ব্যবস্থাপনায় বিবিয়ানা, জালালাবাদ ও মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্র থেকে।

বাংলাদেশের গ্যাসের চাহিদার বড় এটি অংশ যায় বিদ্যুৎ, শিল্প, সার-কারখানা এবং গৃহস্থালি খাতে।

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, যেসব নতুন গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেছে, সেখানে বিশাল কোনো মজুদ নেই। কিন্তু গ্যাসের চাহিদা বেড়েই চলেছে। নতুন করে যে পরিমাণ গ্যাস যোগ হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হারে গ্যাসের মজুদ কমে যাচ্ছে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার বলেছেন, ভোলায় তিনটি গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া গেলেও সেই গ্যাস এখনো জাতীয় গ্রিডে আনা যাচ্ছে না। বাকি যেসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন করা হচ্ছে, চাহিদার তুলনায় তা পর্যাপ্ত নয়। এখন আমরা আরো নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের ওপর জোর দিচ্ছি।’

২০১৬ সালে পাঁচ বছরে ১০৮টি কূপ খননের একটি ঘোষণা দিয়েছিল পেট্রোবাংলা, যার মধ্যে ৫৫টি থাকবে অনুসন্ধান কূপ। কিন্তু সেই পরিকল্পনা পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার, ‘আমরা দেশের ভেতরে নতুন করে গ্যাসের অনুসন্ধান আর উত্তোলনে গুরুত্ব দিচ্ছি। ২০২৪ সালের মধ্যে আমরা ৪৬টি কূপ খনন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর মধ্যে কিছু অনুসন্ধান কূপ থাকবে, কিছু থাকবে উন্নয়ন কূপ আর কিছু ওয়ার্কওভার কূপ।’

নতুন গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে বের করতে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়। ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে উন্নয়ন কূপ খনন করা হয়। আর আগে খনন করা বা পরিত্যক্ত কূপে সেখানে পড়ে থাকা গ্যাস তোলার চেষ্টাকে বলা হয় ওয়ার্কওভার কূপ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশে এখনো অনেক গ্যাস আছে। যথেষ্ট অনুসন্ধান করা হলে এখান থেকে পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া সম্ভব। সেটা করা হলে আমদানি করা এলএনজি গ্যাসের ওপর নির্ভরতা বহুলাংশে কমিয়ে দিতে পারে।’

‘আমরা প্রায়শই গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করছি। সুতরাং আমি মনে করি, এখানে পরিকল্পনামাফিক বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের আরো নজর দেয়া উচিত,’ বলেন তিনি।

কিন্তু এতদিন কেন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হয়নি? এই প্রশ্নের জবাবে জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ স¤পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, ‘অনুসন্ধান হচ্ছে, যার কারণে গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। তবে যে পরিমাণে ড্রাইভটা হওয়া দরকার ছিল, সেটা হয়তো হয়নি। সেটারও কারণ ছিল।’

‘আমাদের যথেষ্ট গ্রিড নেই। অর্থেরও প্রয়োজন হয়। একেকটা ড্রিল করতে ২১ মিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হয়। তবে বাপেক্স অনেক সময় যেভাবে চেষ্টা করা উচিত ছিল, সেভাবে পারেনি, এটা সত্যি কথা। আমাদের আসলে আরো অনেক ড্রিলিং করা উচিত ছিল। এখন আমরা ড্রাইভ দিচ্ছি। গত ১৩ বছরেও তো আমরা অনেকগুলো কূপ পেয়েছি।’

অধ্যাপক বদরুল ইমামও বলেন, উৎপাদন করলে খরচটা খুব তাড়াতাড়ি উঠে আসে। বরং এই ডলারের ক্রাইসিসের সময় বিদেশ থেকে আমদানি করতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে দেশে অনুসন্ধান করে দীর্ঘমেয়াদী গ্যাস পাওয়া গেলে, সেটা ব্যবহার করা গেলে বেশি লাভজনক হয়।

২০০৯ সালের পর বাংলাদেশে ২১টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে মোট পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। এগুলো হলো সুন্দলপুর, শ্রীকাইল, রূপগঞ্জ, ভোলা নর্থ ও জকিগঞ্জ।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে যে গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া গিয়েছিল, সেখান থেকে দশমিক ৬৮ বিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের পর গ্যাস ফুরিয়ে যাওয়ায় উত্তোলন স্থগিত করা হয়েছে। যদিও এখানে ৩৪ কোটি ঘনফুট গ্যাস মজুদ আছে বলে জানানো হয়েছিল।

পাইপলাইনের কাজের কারণে জকিগঞ্জের গ্যাস এখনো বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলন করা বা জাতীয় গ্রিডে আনা সম্ভব হয়নি।

আজারবাইজানের কো¤পানির মাধ্যমে ২০১৭ সালে খাগড়াছড়ির সেমুতাং-৫, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ-৪ এবং জামালপুরের মাদারগঞ্জ-১ কূপ খনন করা হয়েছিল। সেমুতাংয়ে কোনো গ্যাস পাওয়া যায়নি। আর ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক বিরোধে বেগমগঞ্জ ও মাদারগঞ্জের গ্যাস উত্তোলন এখনো শুরু করা যায়নি।

সূত্র : বিবিসি

 

বাংলাদেশ সময়: ২৩:২১:০৬   ২৬১ বার পঠিত