যেসব কারণে বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানে অগ্রগতি নেই

প্রচ্ছদ » অর্থনীতি » যেসব কারণে বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানে অগ্রগতি নেই
রবিবার, ২৯ জানুয়ারী ২০২৩



আজকের ভোলা রিপোর্ট ॥
জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরও বাংলাদেশে শিল্প-কারখানা ও ভোক্তাপর্যায়ে গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ডলার ও বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে যেমন এলএনজি আমদানি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তেমনি দেশীয় উৎসগুলো থেকেও গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে পারছে না সরকার।
যদিও প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের প্রধান খনিজ স¤পদগুলোর অন্যতম। ফলে গ্যাস-নির্ভর বিদ্যুৎ ও শিল্পখাতগুলো নতুন সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে। গ্যাসের সঙ্কটের কারণে সার কারখানা ও অনেক শিল্প-কারখানাও বন্ধ রাখতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে ব্যবসায়ীরা।

---

বাংলাদেশে জ্বালানি গ্যাসের মজুদ কতটা আছে?
বাংলাদেশে বর্তমানে মোট গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে ২৮টি, যার মধ্যে ২০টি থেকে উৎপাদন করা হয়। প্রতিবছর এক ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট (টিসিএফ) করে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, এসব গ্যাসক্ষেত্রে মোট মজুদ ছিল ২৮ টিসিএফ গ্যাস। সেখান থেকে ১৯ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলনের পর বর্তমানে মজুদ রয়েছে ৯.০৬ টিসিএফ। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে এই মজুদ দিয়ে আগামী আট থেকে নয় বছর পর্যন্ত উত্তোলন করা যাবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলছেন, ‘আশির দশকে যখন অনেক গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেল, তখন এমন অবস্থা ছিল যে আমাদের অনেক গ্যাস আছে। কিন্তু চাহিদা ততটা না থাকায় এরপর আর গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
ওই সময় দেশে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহনখাত ও অনেক শিল্প-কলকারখানা গড়ে ওঠে। ২০০১ সালের পর দেশে রাতারাতি গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জ্বালানি খাতের প্রায় ৪৬ শতাংশ গ্যাস খাত থেকে সরবরাহ করা হয়।
কিন্তু বিদেশী কো¤পানিকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধানও কার্যত বন্ধ রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) মাধ্যমেও গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ ছিল না।
খনিজ সম্পদ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘এই পরিস্থিতি যে তৈরি হবে, তা আমরা কেউ জানতাম না। প্ল্যান করতে করতেই আমাদের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আমরা জানতাম না ডলারের এমন ঘাটতি হবে, এনার্জির দাম বেড়ে যাবে। আমাদের কিন্তু কৃষি, শিল্পসহ সব খাতে জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের আমদানি করতে হয়েছে। তবে আমাদের যে রিজার্ভ আছে, তাতে আট থেকে নয় বছর চলবে।’
গ্যাসের চাহিদা মেটাতে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশের সরকার এলএনজি আমদানি করতে শুরু করে। কারণ দেশে চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের চাহিদা থাকলেও প্রতিদিন তিন হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে কো¤পানিগুলো। যার মধ্যে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট আমদানি করা এলএনজি গ্যাস।
দেশে অনুসন্ধান ও উৎপাদনে যে খরচ হয়, তার চেয়ে কম দামে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করতে পারছিল বাংলাদেশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ¯পট মার্কেটে চড়া দামের কারণে চাহিদা অনুযায়ী এলএনজিও আমদানি করতে পারছে না সরকার।
২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের সরকার গুরুত্বের সাথে দেশে গ্যাসের অনুসন্ধান শুরু করে। ওই সময় ২০১১ সালে নোয়াখালী সুন্দরপুরে ও ২০১২ সালে কুমিল্লায় গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া যায়। এছাড়া ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে একটি গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া গেলেও তা থেকে এক বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস তোলার পর বন্ধ হয়ে যায়।
ভোলার ভেদুরিয়ায় ২০১৮ সালে একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাপেক্স। সর্বশেষ ২০২১ সালে সিলেটের জকিগঞ্জে একটি গ্যাসক্ষেত্রে আবিষ্কার হয়। তবে এগুলো থেকে এখনো পুরোপুরি উত্তোলন শুরু হয়নি।
ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্র-বিরোধ নি®পত্তি হলেও বঙ্গোপসাগরে এখনো কোনো অনুসন্ধান কূপ খনন করতে পারেনি বাংলাদেশ। সাগরে এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হওয়া একমাত্র গ্যাসক্ষেত্র সাক্সগুও পরিত্যক্ত হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার তাদের ব্লক থেকে গ্যাস তুলতে শুরু করেছে। বাংলাদেশও তাদের সমুদ্র ব্লকগুলোকে ২৬টি ব্লকে ভাগ করেছে। এসব ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রে চারটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল। তার মধ্যে কনোকোফিলিপস দু’বছর অনুসন্ধান করার পর গ্যাসের দাম নিয়ে মতবিরোধে ব্লক ছেড়ে দেয়।
কনোকোফিলিপস ও সান্তোস দাবি করে, তাদের সাথে হওয়া চুক্তির চেয়েও যেন গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। তাতে বাংলাদেশ সরকার রাজি না হওয়ায় তারা চলে যায়।
পরে সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি, ভারতীয় কো¤পানি ওএনজিসি ভিদেশ ও অয়েল ইন্ডিয়া ইজারা নিয়েছিল। কিন্তু তারাও সরে যায়।
সর্বশেষ ২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু করপোরেশনের সাথে ১২ নম্বর ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের উৎপাদন-অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) করে পেট্রোবাংলা। এই ব্লকের পাশেই মিয়ানমার অংশে সমুদ্র থেকে গ্যাস তুলছে দাইয়ু।
বাংলাদেশের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘আমরা যতবারই দেখেছি, যে কো¤পানিগুলো এসেছে, ড্রিল করতে গিয়ে তারা চলে গেছে। তারা মনে করেছে, যে লেভেলে গ্যাস পাওয়া যাবে, সেটা তুলে তাদের জন্য লাভজনক হবে না। তখন তারা চলে গেছে। দু’বছর আগেও তারা চলে গেছে। এখন সার্ভে আবার শুরু হয়েছে।’
নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার কতদূর?
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এতদিন কেন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে জোর দেয়া হয়নি, তার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।’
এটা বর্তমান সরকারের বিষয় না, বরাবরই আমাদের দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে বা নিজেদের গ্যাস উত্তোলনে কখনো জোরালো অনুসন্ধান হয়নি। ২০০১ সালে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য করা হয়, যে চাইলেই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বে যেখানে পাঁচটা কূপ খনন করলে একটা গ্যাসক্ষেত্র পাওয়া যায়, আমাদের এখানে গড়ে প্রায় তিনটা কূপ খনন করলে একটা পাওয়া যায়। ফলে এখানে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু তারপরেও কেন যেন বাংলাদেশের সরকার গ্যাস উত্তোলনে কখনো খুব বেশি আগ্রহী হয়নি। আমরা বহু বছর ধরে শুনে আসছি, গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ যত অনুসন্ধান করা হচ্ছে, তত নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া গেছে। এগুলো কিন্তু যোগ হচ্ছে। ফলে আমাদের এই খাতে আরো ফোকাস করা উচিত।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, একটা সময় মনে করা হত, বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনে যে খরচ হবে, তার চেয়ে কম দামে বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি করা সম্ভব। এই কারণে বাংলাদেশের সরকার অনুসন্ধানে জোর না দিয়ে গ্যাস আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করেছে।
গ্যাস অনুসন্ধানে এই ধীরগতির কথা স্বীকার করছেন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও।
তিনি বলেছেন, ’অনুসন্ধান হচ্ছে, যার কারণে গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। তবে যে পরিমাণে ড্রাইভটা হওয়া দরকার ছিল, সেটা হয়তো হয়নি। সেটারও কারণ ছিল। আমাদের যথেষ্ট গ্রিড নেই। অর্থেরও প্রয়োজন হয়। একেকটা ড্রিল করতে ২১ মিলিয়নের মতো ডলার খরচ হয়। তবে বাপেক্স অনেক সময় যেভাবে চেষ্টা করা উচিত ছিল, সেভাবে পারেনি, এটা সত্যি কথা। আমাদের আসলে আরো অনেক ড্রিলিং করা উচিত ছিল। এখন আমরা ড্রাইভ দিচ্ছি। গত ১৩ বছরেও তো আমরা অনেকগুলো কূপ পেয়েছি।
তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরুল ইমাম বলেছেন, বাংলাদেশে যে জ্বালানি গ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা আছে, সেটা বিদেশী কো¤পানিগুলোর কাছে তুলে ধরতে হবে। সাথে দামের ক্ষেত্রেও সমন্বয় করতে হবে। এই সম্ভাবনা ঠিক মতো তুলে ধরতে না পারার কারণেই কো¤পানিগুলো আগ্রহী হচ্ছে না। এ বিষয়ে তিনি সরকারি নীতিতে পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিচ্ছেন।
তবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন অনেক কো¤পানি বাংলাদেশের গ্যাসের ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে। বাপেক্সও অনুসন্ধান শুরু করেছে।
তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের গ্যাসের অনুসন্ধান অনেকটা বিশ্ববাজারে গ্যাসের দামের ওপরেও নির্ভর করে।
তিনি আরো বলেন, এখন গ্যাসের দাম বেড়েছে। ফলে অনেক কো¤পানি আগ্রহী হচ্ছে। গ্যাসের আরো এক্সপ্লোরেশন হচ্ছে। এই বছর আরো ৪৬টি ড্রিল হবে। কিন্তু এটা সত্যি যে, আমাদের গ্যাসের মজুদও কমছে। কিন্তু সমস্যা হলো, গ্যাসের দাম যদি বিশ্বে আবার কমে যায়, তখন আর কো¤পানিগুলো আগ্রহী হয় না। কারণ তাদের তো ইনভেস্ট করে লাভ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে এবারের জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে জ্বালানির জন্য নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি উৎস থাকা দরকার। বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র বিকল্প হতে পারে গ্যাসের আরো অনুসন্ধান ও উৎপাদন জোরদার করা।
সূত্র : বিবিসি

বাংলাদেশ সময়: ২১:১৩:৫৪   ২৮৪ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

অর্থনীতি’র আরও খবর


ভোলায় ওমানিয়ান টুপি সেলাই প্রশিক্ষনের সার্টিফিকেট বিতরন
ভোলায় প্রাণীসম্পদ প্রদর্শনী ও উদ্যোক্তাদের মেলা অনুষ্ঠিত
ভোলায় অনুষ্ঠিত হলো প্রাণী প্রদর্শনী মেলা
চরফ্যাশনে দিনব্যাপী প্রাণীসম্পদ প্রদর্শনী
বোরহানউদ্দিনে ফুটপাতে ঈদের জমজমাট কেনাকাটা
পথে পথে চাঁদাবাজি, ভোলার তরমুজচাষি ও ব্যবসায়ীরা বিপাকে
ভোলায় ব্যবসায়িক অগ্রগতি পর্যালোচনা সম্মেলনে রূপালী ব্যাংক পিএলসিকে সর্ব শীর্ষে নিয়ে যাবার অঙ্গীকার
ভেজাল মসলা তৈরি: ভোলায় ২ কারখানাকে জরিমানা
ভোলায় বেড়েছে আলু ও কাঁচা মরিচের দাম
ভোলায় নারী উদ্যোক্তাদের তিনদিনের ঈদমেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ঢল



আর্কাইভ