ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট যেন ভুলে না যাই

প্রচ্ছদ » মুক্তমঞ্চ » ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট যেন ভুলে না যাই
শুক্রবার, ২ জুলাই ২০২১



:মুহাম্মদ শওকাত হোসেন:

শুভ জন্মশতবার্ষিকী। আজ দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এর বয়স একশত বছর পূর্ণ হলো। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এর সঙ্গে আমার চিন্তা ও মনন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট স¤পর্কে কিছু কথা উপস্থাপন করা প্রয়োজন মনে করছি। কোন প্রেক্ষাপটে আজকের বাংলাদেশ তখনকার পূর্ববঙ্গের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আমাদের জানা প্রয়োজন। বৃটিশ সরকারের শেষ দিককার কথা। বৃটিশদের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের অখ্যাত গ্রাম ‘কলিকাতা’ রাজধানী এবং উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহানগর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই অবিভক্ত বাংলার কেন্দ্র ছিল তখনকার কলিকাতা আজকের কলকাতা। পূর্ববঙ্গে সবসময়ই মুসলিমপ্রধান ছিল। এখানকার শতকরা ৮০%  ভাগের বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মুসলমানদের হাত থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলার মসনদ দখল করেছিল। তাই ওদের টার্গেট ছিল মুসলিম সম্প্রদায়। ব্রিটিশদের নির্যাতন-নিপীড়ন, দমন এবং নানামুখী অপকৌশলে মুসলমান সুলতান, নবাব, আমির-ওমরাহ এবং অভিজাত শ্রেণী বিলীন হয়ে গিয়ে সব চাষাভূষায় পরিণত হয়েছিল। তাই পূর্ববঙ্গের শতকরা ৯৫ জন মানুষ ছিল চাষাভূষা, জেলে-তাঁতী ইত্যাদি হতদরিদ্র সম্প্রদায়। এদের শাসন-শোষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল জমিদার তালুকদার শ্রেণীকে। যাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায় ভুক্ত। তারা কলকাতায় থাকতেন আর আনন্দ ফুর্তি করতেন। তাদের নায়েব -গোমস্তারা প্রজাদের উপরে অত্যাচার অবিচার, জুলুম নির্যাতন চালিয়ে এখান থেকে তাদের জন্য আনন্দ-ফূর্তি আর বিলাসিতার টাকা পাঠাতেন। কলকাতায় গড়ে উঠেছিল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্র, বাগানবাড়ি, নাট্যশালা ইত্যাদি। আর এই  সবই ভোগ করতেন এবং নেতৃত্ব দিতেন ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের সহযোগী কিছু এদেশীয় জমিদার তালুকদার শ্রেণি।

---

এমনি এক পেক্ষাপটে পূর্ব বাংলার স্মরণীয়-বরণীয় কৃতিসন্তান ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ এই চাষাভূষা মানুষ গুলোর উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য চেষ্টা করেন। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ তথা পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবির প্রেক্ষিতে তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলাকে দুটি ভাগ করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করে। যার রাজধানী স্থাপিত হয় ঢাকায়। রাজধানীর অফিস-আদালত ইত্যাদি সৃষ্টির প্রয়োজনীয় জায়গা-জমি নবাব সলিমুল্লাহই দান করেছিলেন। রাজধানীর মর্যাদা পেয়ে ঢাকা আবার যৌবন প্রাপ্ত হয়ে ওঠে। অফিস-আদালত আর্জন কলরবে ভোরে উঠে। ১৯০৬ সালে ঢাকায় আহসান মঞ্জিলে সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনে প্রতিষ্ঠিত হয় উপ মহাদেশের মুসলমানদের আলাদা রাজনৈতিক সংগঠন ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ’। সেই শিক্ষা সম্মেলনে সর্বভারতীয় মুসলিম নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর, মাওলানা শওকত আলী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, হাকিম আজমল খান, নবাব ভিকার উল মূলক, নবাব মহসিনুল মূলক সহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে এবং নবাব স্যার সলিমুল্লাহসহ তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দের অন্যতম দাবী ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার সাধারন মানুষদের উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এ দাবির পক্ষে সোচ্চার ছিলেন বাংলার আরেক কৃতি সন্তান জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এই দুজনের নাম ভুলে গেলে ইতিহাসের প্রতি অবজ্ঞা করা হবে।
প্রথম থেকেই সুবিধাভোগী ব্রিটিশদের ঘনিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এমনকি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সহ কলকাতাকেন্দ্রিক কবি-সাহিত্যিকগণ বঙ্গভঙ্গ কে সমর্থন করতে পারেনি। বরং তারা বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এর নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে। যুগান্তর, অনুশীলন সংঘ, আরএসএস সহ বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসী সংগঠন এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ সরকারকে অস্থির করে তোলে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯১১ সালে দিল্লিতে স¤্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে দেন এবং পূর্ব বাংলাকে পুনরায় কলকাতার অধীনস্থ করে দেন। ওই সময় ব্রিটিশ সরকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ও মুসলিম নেতৃবৃন্দ কে খুশি করার জন্য তাদের প্রধান দাবি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। সেটাই পরবর্তীকালে ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় তিনটি অনুষদ, কলা, বিজ্ঞান ও আইন এবং বারোটি বিভাগ নিয়ে। শিক্ষক ছিলেন ৬০ জন, শিক্ষার্থী ৮৭৭ জন। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৪ টিতে, ইনস্টিটিউট ১৩টি, শিক্ষক ১৯৯২ জন, শিক্ষার্থী ৩৭ হাজার ১৮ জন ও ৫৬টি গবেষণা কেন্দ্র হয়েছে।
শতবর্ষের প্রান্তে এসে একটাই প্রশ্ন- যে চিন্তা-চেতনা অনুভূতি এবং উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা হয়েছিল সেটা কি আমরা রক্ষা করতে পেরেছি? বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কত সংখ্যায় দাঁড়িয়েছে? যতদূর শুনেছি প্রথম ২০০ এর মধ্যে নেই। মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, একজন শিক্ষার্থীকে মানুষের মত মানুষ হিসেবে তৈরি করার ক্ষেত্রে বর্তমানে কতটা সফল হচ্ছে, আজ সেটাই প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর যদি নেতিবাচক হয়, শত বছরের প্রান্তে এসে আমাদেরকে শপথ নিতে হবে আমাদের এই প্রধান সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তার মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠারমূল চেতনার বাস্তবায়ন করা। আমাদের প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকার এ বিষয়টির প্রতি নজর দেবেন।
লেখক: মুহাম্মদ শওকত হোসেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
সাবেক অধ্যক্ষ ও সম্পাদক দৈনিক আজকের ভোলা।

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৪২:১৫   ৮৫৮ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

মুক্তমঞ্চ’র আরও খবর


ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রস্তুতি
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি থেকে
আমার দেখা নিউইয়র্ক শহর
মুদ্রাস্ফীতিতে বাংলাদেশ
রোগীর সম্পৃক্ততাই তার নিরাপত্তা
বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের প্রেরণা
বেদনায় ভরা দিন
অর্থনীতিতে নার্সারিশিল্প
এলসি, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও উত্তরণ
উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অপর নাম আওয়ামী লীগ



আর্কাইভ