শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হানিফের ৫০তম শাহাদাত বার্ষিকী ও কিছু কথা

প্রচ্ছদ » জেলা » শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হানিফের ৫০তম শাহাদাত বার্ষিকী ও কিছু কথা
রবিবার, ২৩ মে ২০২১



নিজস্ব প্রতিবেদক ॥
শহীদ মোহাম্মদ হানিফ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন নিবেদিত প্রাণ কর্মী, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, পরামর্শদাতা ও সংগঠক। ২৫ মে ১৯৭১ দিবাগত রাতে সিংসাড়ার আরো ২৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্মমভাব শহীদ হন। তিনি ১৬ জুন ১৯৪১ সালে ভোলা জেলার সদর উপজেলার পশ্চিম চরনোয়াবাদ গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলহাজ্ব মোঃ হাবিবুর রহমান এবং মাতা জমিলা খাতুন।
শহীদ মোহাম্মদ হানিফ ভোলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় হতে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সরকারী ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ¯œাতক ডিগ্রী লাভ করে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (বর্তমান সোনালী ব্যাংক লিমিটেড) এ তিনি যোগদান করেন। কর্মজীবনে খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর কর্মময় জীবন কাটান এবং বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে তিনি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান এর নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ শাখার ম্যানেজার নিযুক্ত হন। সপরিবারে তিনি আত্রাই রেলস্টেশন সংলগ্ন বিহারীপুরের জনাব হাশেমের বাসায় বসবাস করতেন। হাশেমের বাড়ীটি ছিলো সংগ্রাম কমিটির বৈঠক স্থল, যেখানে নিয়মিত বৈঠকে অংশ নিতেন আত্রাই সংগ্রাম কমিটির সদস্যগন সর্ব আঃ আঁজিজ, সিংসাড়ার মকবুল চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহিদুর রহমান, ডাঃ সিরাজ উদ্দীন, বাদল দত্ত, তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, ডাঃ আঃ খালেক। এ বৈঠকে নিয়মিত সংগোপনে, অংশগ্রহণ করতেন শহীদ মোহাম্মদ হানিফ।

---

তৎকালীন সময়ে আত্রাই এর মত প্রত্যন্ত এলাকায় একজন সৎ, সুশিক্ষিত ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য একনিষ্ঠ মানুষ হওয়ায় স্থানীয় মানুষ তাকে খুবই শ্রদ্ধা করতো। তিনি একেবারেই আত্রাইর মাটির মানুষ হিসাবে পরিচিত হন। সদালাপী ও সদা হাস্যোজ্জল শহীদ মোহাম্মদ হানিফ সহজেই মানুষের সাথে মিশতেন। স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তি যেমন সর্ব আঃ আজিজ, সিংসাড়ার মকবুল চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসেম, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহিদুর রহমান, ডাঃ সিরাজ উদ্দীন, বাদল দত্ত, তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, ডাঃ আঃ খালেক, রানীনগরের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক প্রমুখের সাথে চলে তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবন।
সরকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের ম্যানেজার হয়েও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক তাঁর প্রানে দোলা দেয়। আত্রাই এ স্থানীয় মানুষ না হয়েও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শহীদ মোহাম্মদ হানিফ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনে সক্রিয় সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করেন। জীবনের ভয়কে অতিক্রম করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা শুরু করেন। তবে রাজারকারদের দৃষ্টি ফাঁকি দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি, যা তিনি ও বুঝতে পেরেছিলেন। তার পক্ষে না সম্ভব ছিল ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া, না সম্ভব ছিল অস্থানীয় হয়ে অন্তঃসত্তা স্ত্রী সহ পরিবারকে আগ্রাইতে অরক্ষিত রেখে যুদ্ধে সশরীরে যোগ দেওয়া। তবে স্বাধীনতা অর্জনের অদম্য আকাঙ্খা শহীদ মোহাম্মদ হানিফ এর জীবনের ঝুঁকি অতিক্রম করতে সহায়ক হয়। তিনি বুদ্ধি পরামর্শ, ও অর্থ যোগানের মাধ্যমে মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয় থাকেন। বিভিন্ন অবস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের মিটিংয়ে নিয়মিত যোগ দেন এবং সক্রিয় সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
এপ্রিল ৭১ এর শেষ দিকে পাকিস্তান আর্মি আএাইতে ক্যাম্প স্থাপন করার পর আর্মির একটি দল ব্যাংকের অতিরিক্ত নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা জানার জন্য ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাইতে গমন করে। চলে যাওয়ার সময়ে ভুলবশত তাদের একটি ম্যাপ ব্যাংক ম্যানেজারের টেবিল রয়ে যায়। শহীদ মোহাম্মদ হানিফ ম্যাপটি মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট হস্তান্তর করেন। পরের দিন পাকিস্তান আর্মির লোকজন ম্যাপের খোজে ব্যাংকে এসে শহীদ হানিফকে জিজ্ঞাসাবাদ করো শহীদ মোহাম্মদ হানিফ ব্যাংকে কোন ম্যাপ ছিলো না বলে জানান। এতে পাকিস্তানি সেনাদল নাখোশ হয়ে চলে যায় এবং হানিফের পিছনে রাজাকার গোয়েন্দা নিয়োগ করে।
আত্রাই প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠনের জন্য আর্থিক ও সাংগঠনিক কিছু কিছু বিষয়ে সহায়তা আবশ্যক ছিল। তৎকালীন সময়ে আর্থিক সহায়তার উৎস খুবই কম ছিল। মুক্তিযুদ্ধের নিবেদিতপ্রাণ শহীদ মোহাম্মদ হানিফ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে আর্থিক, সাংগঠনিক ও উৎসাহ প্রদানকারী হিসাবে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে নিজে সক্রিয় ও সম্পৃক্ত থাকার কাজটি তিনি জীবন ও পেশার ঝুঁকি নিয়ে, সাহসিকতার সাথে করেন। দেশমাতার মুক্তির জন্য তিনি দেশপ্রেমকে প্রাধান্য দিয়ে, জীবনের ও চাকুরীর ঝুঁকি নিয়ে, অফিশিয়াল দায়িত্বশীলতাকে অতিক্রম করে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ, পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করে যান। এর মধ্যে বিহারীপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেমের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জনাব ওহিদুর রহমানের নিকট একত্রে ৩০০০০/-(ত্রিশ হাজার) টাকা পাঠানোর ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ভাবে সর্বমোট আশি হাজার টাকা তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দেন। অন্য এলাকার মানুষ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর সাহসিকতা ও দায়িত্ববোধ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে দারুনভাবে উৎসাহিত করে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অর্থ প্রদানের বিষয়টি স্থানীয় কুখ্যাত রাজাকার মজিদ মোল্লার অনুসারীরা আগ্রাইতে অবস্থানরত পাক বাহিনীকে জানিয়ে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অর্থায়ন করা ও হারানো ম্যাপের সন্দেহে মে ৭১ এর প্রথমদিকে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাংকে এসে শহীদ মুহাম্মদ হানিফকে শারিরীক ও মানসিকভাবে চরম নির্যাতন করে। স্থানীয় সরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার বিষয়টি পাকিস্তানি বাহিনী জেনে ফেলায় মৃত্যু তার জন্য অবধারিত হয়ে পরে। এতে তিনি ও তার পরিবার ভীষণভাবে মর্মাহত ও চিন্তিত হয়ে পরেন। এরপর বাড়ীওয়ালা হাশেমের পরামর্শে মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে শহীদ মুহাম্মদ হানিফ ১ মেয়ে, ২ ছেলে এবং অন্ত:সত্ত্বা স্ত্রীসহ তাঁর পরিবারকে নিজ বাসা ছেড়ে আত্রাই শহর থেকে ৪.০০ কিঃমিঃ দূরে সিংসাড়ার মকবুল চেয়ারম্যানের বাড়িতে রেখে আসেন। শুরু হয় তার যাযাবরী জীবন। আজ এখানে কাল ওখানে থেকে তিনি অফিস করতেন এবং সুযোগমত সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত ও সহায়তা করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করতে থাকেন।
মাঝে মধ্যে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের দেখতে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আসতেন। ২৫ মে ১৯৭১ রাতে তিনি স্ত্রী সন্তানদের সাথে দেখা করতে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আসেন এবং পরিবারের সাথে দেখা করার পর তিনি চেয়ারম্যানের বাড়িতে অন্যান্য ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার সাথে বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। রাজাকারদের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে রাতেই পাকসেনারা চেয়ারম্যানের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। আঁচ করতে পেরে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে মকবুল চেয়ারম্যান এর শ্যালক আত্রাই কলেজের ভিপি মুজিবুর রহমান পাকসেনাদের প্রতি গুলিবর্ধন করেন। শুরু হয় স্বশস্ত্র যুদ্ধ। ক্ষণস্থায়ী প্রতিরোধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। এরপর ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মকবুল চেয়ারম্যানের বাড়িতে একটি বধ্যভূমিতে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২৯ জন শহীদ হন, ০২ জন আহত হন এবং বাকী ০২ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। রাজাকারদের ইন্ধনে পাকিস্তানী বাহিনী ২৬ মে ১৯৭১ সকালে শহীদ মোহাম্মদ হানিফের বাসা সহ আত্রাই শহরের ২০-২৫টি বাসা পুড়িয়ে দেয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোহাম্মদ হানিফ স্বাধীনতাযুদ্ধের নিবেদিত প্রাণ সক্রিয় সাহসী কর্মী যিনি বুদ্ধি, পরামর্শ, ও অর্থ যোগানের মাধ্যমে আত্রাই এর মানুষের মনিকোঠায় অবস্থান করেন। ২৫ মে ১৯৭১ রাতে সিংসাড়ার আরো ২৯ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। রাজাকারদের ইন্ধন আর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতায় এই মুক্তিযোদ্ধাগন শহীদ হয়ে আত্রাইয়ের মানুষকে স্বাধীনতার লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছেন।
বুদ্ধিজীবী বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোহাম্মদ হানিফ এর স্ত্রী মিসেস রাজিয়া বুলবুল একজন সার্থক মাতা। তিনি নিজ জেলা ভোলায় বসবাস করেন। তার গর্বিত সন্তানদের মধ্যে বড় মেয়ে ফাতেমা জোহরা সিনিয়র শিক্ষিকা ভোলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, বড় ছেলে মোঃ মিজানুর রহমান এজি এম, সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, মেঝো ছেলে এইচ এম মাসীহুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং ছোট ছেলে মোঃ মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, ভোলায় অফিসার হিসাবে কর্মরত আছেন। বুদ্ধিজীবী, পরামর্শদাতা, সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মোহাম্মদ হানিফের আত্মত্যাগে আমরা এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম গর্বিত।
২৬ মে রোজ বুধবার শহীদ রীব মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হানিফ এর চরনোয়াবাদ, ভোলাস্থ বাসভবনে শহীদ মোহাম্মদ হানিফ এর স্মরণে দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৪১:০৬   ৮৪০ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

জেলা’র আরও খবর


সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোলায় সমাবেশ
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য কাচারি ঘর বিলুপ্তির পথে
ভোলায় ৬ দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর সরকারি চাকরিজীবী ফোরামের স্মারকলিপি
ভোলায় তীব্র তাপদাহে অস্থির জনজীবন
ছয় শতাধিক শিক্ষার্থীর পাঠদানে অনিশ্চয়তা
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: ভোলায় তিন উপজেলার ৩৮ প্রার্থীর সকলের মনোনয়নপত্র বৈধ
ভোলায় কৈশোর বান্ধব স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত
ঘুষ ছাড়া কাজ হয়না ভোলার বিএমইটি অফিসে॥ প্রতিদিন ঘুষের আয় প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা!!
আপনাদের আমানত ভাল পাত্রে জমা রাখবেন: চেয়ারম্যান প্রার্থী ইউনুছ মিয়া
ভোলায় ফিল্মি স্টাইলা অপহরণ ॥ কতিপর উদ্ধার



আর্কাইভ