বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪

সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর ॥ ধ্বংস সৃষ্টি উৎপাদন রাজনীতি

প্রচ্ছদ » ফিচার » সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর ॥ ধ্বংস সৃষ্টি উৎপাদন রাজনীতি
বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর ২০২০



---

: এএইচএম নোমান :

প্রকৃতি ও মানব সৃষ্ট ধ্বংস উভয়টি আমাদেরকে মোকাবেলা করতে হয়। মাটি, বাতাস, আগুন পানি দিয়ে সৃষ্টিকর্তা উপকার পৌছায়। অপর পক্ষে সৃষ্টিকর্তার হুকুম আহকাম না মানলে আবার এসব দিয়েই ধ্বংস হয়। মানব সৃষ্ট মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহ, বঞ্চনা, শোষণ এগুলো আমাদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর হলো প্রাকৃতিক ধ্বংস। রোজা, কনকনে শীত গভীর রাত। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান উপকূলীয় এলাকা দিয়ে ভয়াল জলোচ্ছ্বাস বয়ে যায়। হিংস্র তান্ডবে বেসরকারীভাবে ১০ লাখ আদম সন্তানের সলিল সমাধি ঘটে। কোটি কোটি টাকার পশু সম্পদ, ফসল-ফসলাদি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, স্থাপনা, ঘরবাড়ী, গাছ-গাছালি, রাস্তা ঘাট, ব্রীজ, সাঁকো সব লন্ডভন্ড করে দেয়। গরু, ছাগল, মহিষ, কুকুর, বিড়াল, পশু পাখির মৃতদেহ, নারী-পুরুষ-শিশুর লাশ বেড়ী, নদীতে কচুরি পানার মত থরে থরে ভাসমান মৃত দেহ, সড়ক ঢালুতে-উঁচুতে লেপটে এক ভয়াল চিত্র। সাড়া উপকূল ব্যাপী যেন এক মৃত্যুপুরী। রামগতির চর আবদুল্লাহার হাজী আলী হোসেনের কোলের কন্যা সন্তান স্রোতের তোড়ে নিয়ে যাওয়া, ঘরের টুপরি ধরে ভেসে বেচে থাকার মতো হাজারো দৃশ্য স্মৃতি কাল রাতের সাক্ষী। একই ধরণের প্রাকৃতিক জলোচ্ছাস চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় এলাকায় ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। এ ধরণের মঙ্গা, খড়া, পাহাড়ি ঢল, নদী ভাঙ্গন, বন্যা, দূর্ভিক্ষ, শৈত্যপ্রবাহ, বজ্রপাত ইত্যাদি হরেক রকম আজাব গজব আমাদের নিত্য নৈমত্তিক সঙ্গী। স্বাস্থ্য ঝুকিতে চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গু, করোনা, মরণব্যাধি আতংকের অপর নাম। এ সকল ধ্বংসের চাল চরিত্রের মধ্যে থেকেই আমাদের জীবন সংগ্রাম চালিত হচ্ছে।  চলতে থাকে দূর্যোগে সারা দেশবাসী সম্বিত হারিয়ে দিশেহারা। পথ খোঁজার রাস্তা, ক্ষুধার তাড়না, সহায় সম্পদ স্বজনহারা আশ্রয়হীন জীবন জীবিকাহীন বেঁচে থাকাদের আহাজারী। চোখের পানি শুকিয়ে ‘ধ্বংস থেকে সৃষ্টি’র হাতছানির বজ্র কঠিন ভীত তৈরী হয়। শ্লোগান দেয়া হলো “The Dead need not us but we need them, they may serve us still”. কবি নজরুলের ভাষায় ‘যাহা চাই যেন জয় করে পাই গ্রহণ না করি দান হে সর্বশক্তিমান’। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলা শুরু হলো ‘ভিখারীর হাত হোক কর্মীর হাতিয়ার।’ জানান দিলো We Want Release but Not Relief. জাতি হাতড়ে নিলো ‘Let the Dead, Serve the Living’। দেশী বিদেশীদের কাছ থেকে পরিচিতি পেলাম ‘বন্যার ফসল’ The Product of Cyclone. খোঁজে উৎপাদন লক্ষে- ত্রাণ পুনর্বাসন ও উৎপাদন কাজে তাঁবু, কম্বল, চাষের গরু, ট্রাক্টর, বীজ, পানের বরজের বাঁশ, ঘর, জেলেদের নৌকা-জাল ইত্যাদি দিয়ে পুনর্বাসনের কার্যক্রম সরকারি বেসরকারি সহায়তায় সমবায় পতাকায় শুরু করলাম। দীর্ঘ মেয়াদি যুদ্ধের আশংকায় ‘একই সঙ্গে উৎপাদন যুদ্ধও শুরু হলো। গুচ্ছকারে সার্বিক উন্নয়ন মডেল ‘বিশ্বগ্রাম’ স্থাপন হলো। কৃষি পুনর্বাসনে শীতকালীন সবজি, বীজ, আলু, বাদাম, সয়াবিন, ভুট্টা, গম, গাজর, লেটুস, ফুল কপি, বাঁধা কপি ইত্যাদি ‘সবজি ভাত’ আন্দোলন চাষাবাদ করা হলো। ফলশ্রুতিতে লক্ষ্মীপুর এখন সয়াবিন জেলা নামে পরিচিত। নৌকা জাল ও যান্ত্রিক মাছ ধরার লঞ্চ দিয়ে জেলেদের পুনর্বাসন কাজ চলল। এভাবেই মাছ, মুরগী, গবাদি পশু (মামুগ) আন্দোলন শুরু করা হলো। পর্যায়ক্রমে মামুগতে দেশ এখন স্বনির্ভর। সৃষ্টি হলো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শক্তিমালা।
রাজনৈতিক দূরদর্শী শক্তি এনে দিল মুক্তি। ১২ নভেম্বর ১৯৭০ এর পূর্বে স্বাধিকার আন্দোলন লক্ষ্যে রোপিত বীজ ৬ দফা আন্দোলন ১ (এক) দফায় ত্বড়িৎ গড়াতে লাগল, পাকিস্তান জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১৯৭০ সাইক্লোন বিধ্বস্ত উপকূলীয় এলাকায় স্থগিত করা হলো। মৃতদের জীবনের বিনিময়ে দেশের ও দুনিয়ার উপলদ্ধির জাগরণের ফসল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষিত হয়ে ২৬ মার্চ ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। প্রশ্ন দেখা দিল, খোদ পাকিস্তানী শাষকরা কোথায়? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ উপকূল গ্রামে চরে, ঘাটে, হাটে, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে যোগ ও জোর দিলেন। ভাসানী সাহেব ওয়ালাইকুম ছালাম জানিয়ে পাকিস্তানীদেরকে বিদায় বার্তা জানিয়ে দিলেন। দেশবাসী রাজনৈতিক মুক্তি ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান ও এগিয়ে নিলেন।
১৯৭০ এর ১৫ কি ১৬ নভেম্বর। তৎকালীন ভোলা মহকুমার দৌলৎখাঁ থানার হাজীপুর ইউনিয়নের (বর্তমানে নদীগর্ভে) জগাপাতা  ঘোলপাড় নদী নৌকা ঘাট। বঙ্গবন্ধু লঞ্চযোগে বন্যা-জলোচ্ছাসে মনপুর পথে বিধস্তদের জন্য ত্রাণ সামগ্রীসহ সাহায্য সাহস ও সুখ দুঃখ দূর্দশা ভাগাভাগি করার জন্য বন্যা কবলিত দূর্গত মানুষের কাছে মানবিকতা নিয়ে এসেছেন। সঙ্গে চেনা মুখের মধ্যে তৎকালিন ছাত্রনেতা ভোলা তথা দেশ গৌরব তোফায়েল আহমেদ, তোফায়েল ভাই। আমি একটা ছোট্ট লেদার বক্সসহ নদী ঘাটে এসেছি। নদীর পূর্বপার আলেকজান্ডার (রামগতি, নোয়াখালী) বন্যা পরবর্তী অবস্থা দেখার জন্য যাব। তৎকালে নদী পারাপারের জন্য ইঞ্জিন নৌকা বা লঞ্চ ছিল না। নৌকা লগি-বৈঠা, দাঁড় ও পালে চলত। ঘাটে বঙ্গবন্ধুকে দেখে আকুলভাবে আবেগে কাছে এগিয়ে গেলাম। ‘আসসালামু আলাইকুম, আমি নোমান, ছাত্রলীগ করতাম, সিএ পড়ি, এখানে আমার বাড়ী-জন্ম ভূমি, তাই বন্যা পরিস্থিতি দেখতে এলাম। বঙ্গবন্ধু, ও তুই নোমান! জি¦ হ্যাঁ। কেমন দেখলি অবস্থা? এক কথায় ভয়াবহ। এখন এখানে কি? ওপার যাব-সেখানে আমার পিত্রালয়, আব্বা আম্মা থাকেন ও বন্যা পরিস্থিতি দেখতে যাব। বঙ্গবন্ধু, যা-যা দেখ কি করা যায়। ঠিক আছে, কাজে লেগে যা- কাজে লেগে যা। এই তোফায়েল দেখ, তোমারই এলাকার ছেলে। ভাল, এদেরকে দিয়ে কাজ হবে। ভাল ভাল। তোফায়েল ভাইর মনে থাকার কথা না। এ ছাড়া পূর্ব পরিচিত নই। তবে চাহনিতে কাছে নিয়েছে বুঝা গেল।’
বন্যা-স্বাধীনতাত্তোর ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মুক্ত স্বাধীন দেশ পুনর্গঠন লক্ষ্যে সর্বপ্রথম রামগতির (আমার কর্ম এলাকা) চর পোড়াগাছা গ্রামে গিয়েই বঙ্গবন্ধু স্বেচ্ছাশ্রম, উৎপাদন ও গ্রামোন্নয়নে ডাক দিয়েছিলেন। ঐ ডাকের ফলশ্রুতিতে রামগতিস্থ বঙ্গবন্ধু শেখের কিল্লা আজ উন্নয়ন বাতিঘর। এখনো জাতির পিতার দেশজ উন্নয়ন রণ কৌশলের পুনরাবৃত্তি করাই হবে আমাদের পথ ও পাথেয়।
করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ বিশ^কে সমতালে আনা এ ধ্বংস লীলার জমিন থেকে অর্থনৈতিক মুক্তির বাংলাদেশ বিনির্মানে মুজিব-বর্ষ স্মরণে বঙ্গবন্ধুর শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়তে সাম্যতা ও ন্যয্যতার একটি বিশাল শিক্ষা আমাদের দ্বারপ্রান্তে। পৃথিবীব্যপী সৃষ্টিকর্তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-গরীব নির্বিশেষে সব এক করে ফেলেছেন। কোথাও এখন কোন মন-চিন্তা-ভাবনার বৈষম্য ও বিভেদ নাই। সারা বিশে^র এ একতাবোধ বিশ^কে আপাতঃ (?) এক করে ফেলেছে। অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটিয়ে পৃথিবীটাকে মাথা উঁচু করে আবার দেখিয়ে দেয়ার সময় এখনই। ‘পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করব’ ঘোষণার রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দূরদর্শী পদক্ষেপে বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মডেল। কম্যুনিষ্ট করোনা ভাইরাসে আমাদেরকে যে শিক্ষা দিল তা হলো, বিশ্ব দরবারে নিজের পায়ে দাড়ানোর এটাই মোক্ষম সুযোগ ও সময়। সারা বিশ্ব এখন করোনার আযাবে টালমাতাল। বর্তমানে শোষক, শোষণ, তোষণ ও বৈষম্য ভিন্ন চরিত্র রূপে দেশে ফিরাউন, কারুন, আদ, সামুদ, লুত এর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
তাই প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা, সৎ ন্যায়বান দেশ প্রেমিক ত্যাগী গণমুখী রাজনীতিকদের অভ্যুত্থান চাই। ধর্মীয় অনুশাসন মানা, করোনা ভাইরাসের বড় চাওয়া। মন চিন্তার সংস্কারসহ রাজনৈতিক সংস্কার অপরিহার্য। প্রকৃতিকে এগিয়ে দিয়ে ‘মুক্তি’র চেতনাধারীদের জায়গা করে দিতে ও নিতে হবে। ১২ নভেম্বরকে মুক্তির বীজ উপলব্ধির তাড়নায় প্রজন্ম উদ্যোক্তারা ‘উপকূল দিবস’ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে। আমরা এর স্বপক্ষের শক্তি ও স্মৃতি-সাক্ষীর অংশী। শুধু যাতনায় ভুগছি ধনী-গরীব বৈষম্য দিন দিন যেভাবে বাড়ছে তাঁর সমাপ্তি কোন দিন কিভাবে হবে? এসডিজি ১৭টি এজেন্ডার ১নং এজেন্ডা ঊহফরহম ঢ়ড়াবৎঃু কে চূড়ায় রেখে বেসরকারী সংস্থা র্ডপ প্রবর্তিত দরিদ্র মা’দের ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা কেন্দ্রীক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, কর্মসংস্থান, পরিবেশ, সঞ্চয়সহ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পাইলটকৃত ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ কার্যক্রমই পারে ন্যয্যতা-সাম্যতা ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে।
১২ নভেম্বর ১৯৭০, ভয়াল এক কালরাতের ১০ লাখ মানব সন্তানের সলিল সমাধি মনে করিয়ে দেয়, ২০২০ সালে ৫০-অর্ধশত বছর পর একই ১২ নভেম্বর বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসে এক বছরের তান্ডবে ১২ লাখ উর্দ্ধে সাদা-কালো-বাদামি, নারী পুরুষের অসহায়ত্বের ইতিগাঁথা প্রাণহানী। শক্তিধর ট্রাম্প থেকে শুরু করে কমিউনিষ্ট চীন, রাম-রহিম কেউই কিছু করতে পারছে না। ১২ নভেম্বর ১৯৭০ এবং করোনা নভেম্বর ২০২০ আমাদেরকে আবারও হুশিয়ার করে দিল স্মৃষ্টিকর্তার আজাব-গজব থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নির্দেশিত সৎ পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে হবে। আল্লাহর কাছে সমর্পণই হলো আমাদের অন্তিম শিক্ষা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, র্ডপ এবং উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংগঠক। ই-মেইল-

বাংলাদেশ সময়: ১:২১:২৭   ৫৭৬ বার পঠিত