বুধবার, ২০ মার্চ ২০২৪

সরকারের বিনামুল্যে ক্ষুরারোগের ভ্যাকসিন বঞ্চিত ভোলার প্রান্তিক খামারিরা

প্রচ্ছদ » অর্থনীতি » সরকারের বিনামুল্যে ক্ষুরারোগের ভ্যাকসিন বঞ্চিত ভোলার প্রান্তিক খামারিরা
বৃহস্পতিবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২১



আদিল হোসেন তপু ॥
ভোলায় প্রানী সম্পদ দপ্তরের গবাদি রোগ নির্মূলের জন্য ‘পিপিআর রোগ নির্মূল ও ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণ’ নামের একটি সরকারি প্রকল্পের খামারিদের জন্য বিনামূল্যের ভ্যাকসিন দেওয়ারা কথা থাকলেও তা পাচ্ছেনা প্রান্তিক খামারিরা। ফলে অনেক খামারির গবাদি পশু ক্ষুরারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। খামারিদের অভিযোগ প্রকল্পটি বর্তমানে ভ্যাকসিন কার্যক্রম অনেকটা কাগজে কলমের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভ্যাকসিনগুলো প্রাণীসম্পদ অফিসের ভ্যাকসিনেটর ভলেন্টিয়ারদের দিয়ে পাশ্ববর্তী জেলায় নিয়ে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর কিছু অসাদু কর্মকর্তার ও কর্মচারীদের কারণে এই প্রকল্পের কোন সুফল পাচ্ছেনা বলে জানান খামারিরা। আর জেলা প্রাণী কর্মকর্তা জানান, ক্ষুরারোগের ভ্যাকসিন সকল খামারি পেয়েছেন বলে দাবি করেন। আর যারা ভ্যাকসিন না দিয়ে বাইরে বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা নেয় হয়েছে বলে জানান।

---

দেশের ক্রমবর্ধনশীল জনসংখ্যার আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য সরকার খামারিদের গরু-মহিষের ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য  বিনামূল্যে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। এ রোগ নির্মূলের জন্য ‘পিপিআর রোগ নির্মূল ও ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণ’ নামের একটি প্রকল্প  গ্রহণ করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে ভোলা জেলার ৬৯ ইউনিয়নে প্রত্যেক খামারি জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় গবাদি পশুর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ‘হেলথ কার্ড’। আর  কার্ডের মাধ্যমে গবাদি পশুকে নিয়মিত টিকা ও কৃমিনাশক ওষুধ ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু জেলা প্রানী সম্পদ দপ্তরের কিছু অসাদু কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের মাঠ কর্মীদের দিয়ে সেই ভ্যাকসিন খোলা বাজারে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছে। যার কারণে খামারিরা সেই ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছে প্রান্তিক খামারিরা।
ভ্যাকসিনের অভাবে মারা যাচ্ছে গবাদিপশু। অন্য দিকে ভেস্তে যাচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পও। ভ্যাকসিন না পেয়ে তাদের গবাদি পশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। যারা সরকারি ভ্যাকসিন বিনামূল্যে না দিয়ে বাজারে বিক্রি করছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান খামারিরা। আমিষের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারিভাবে প্রান্তিক খামারিদের জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিন যারা বাইরে বিক্রি করেছে এই চক্রের সকলকে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি জানান তারা। পাশাপাশি খামারিদের জন্য সরকারি বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি তুলেন।
ভোলা সদর উপজেলা ইলিশা ইউনিয়নের আকতার ডেইরি ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা মো: আকতার হোসেন জানান, গবাদি পশুর খামারিদের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ সরকার বিনামূল্যে ক্ষুরারোগের ভ্যাকসিন দেওয়ার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অথচ আমরা যারা খামারি আমরা সরকারের এই প্রকল্পে কোন সুফল পাচ্ছিনা। আমাদেরকে বাইরে থেকে চড়ামূল্যে ভ্যাকসিন ক্রয় করে গবাদি পশুর সুস্থতার জন্য প্রদান করতে হয়। যেহেতু সরকার বিনামূল্যে এই ভ্যাকসনি সরবরাহ করছে সেহেতু সবাইকে এই ভ্যাকসিন সরবরাহ করা উচিত। তাহলে উপকূলের প্রান্তিক চাষীরা গরুর ক্ষুরারোগ থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে আমিষের চাহিদা পূরণে খামারিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানান।
তিনি আরো জানান, ভ্যাকসিন হচ্ছে একজন খামারির মূল শক্তি। কারণ গবাদি পশুর ক্ষুরারোগ হলে খামারিকে একদম নি:শেষ করে ফেলে। তাই সরকারে এই বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সেবা সকল খামারির মাঝে সুষ্ঠভাবে বন্টন করে দেওয়ার দাবি জানান।
একই উপজেলার আরেক খামারি শ্যামল বাংলা কৃষি খামারের কর্ণধার মনিরুল ইসলাম জানান, ভোলা গবাদি পশু পালনের জন্য একটি উর্বর ভূমি। কিন্তু এখানে গবাদি পশু পালন করতে গেলে নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খামারিরা নিয়মিত সরকারি ভ্যাকসিন ও ঔষুধ না পাওয়া। বিশেষ করে এখানে পশু ডাক্তাররা খামারগুলো ঠিকমতো তদারকি করেন না। এছাড়াও ক্ষুরারোগ গোটা পশু পালন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। সেখানে সরকার ক্ষুরা রোগের ভ্যাকসিনের জন্য নিয়মিত বরাদ্দ দিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করছে। অথচ এই ধরণের প্রকল্প কার্যক্রমগুলো জেলা প্রাণী দপ্তর কাগজে কলমে দেখায় বাস্তবে নেই। আমাদের ভ্যাকসিন না দিয়ে সরকারিভাবে এই ভ্যাকসিনগুলো পাশ্ববর্তী  জেলায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়। আমরা জোড় দাবি জানাচ্ছি সরকার যথাযথ তদারকির মাধ্যমে সরকারিভাবে যে ভ্যাকসিন আসে তা যেন প্রান্তিক খামারিরা পায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
ভোলার চরসামাইয়া ইউনিয়নের খামারি মো: শাহজাহান হোসেন জানান, গরুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোগ ক্ষুরারোগ। অথচ সরকারিভাবে এই রোগ নির্ণয় করার জন্য এত কিছু আসে তা আমরা কিছুই পাইনা। এমনকি জানিও না। শুনছি প্রতি ইউনিয়নে ভ্যাকসনি দেয়ার জন্য একজন করে ভলেন্টিয়ার আছে তাও জানিনা। উল্টো গরু অসুস্থ হলে বাড়িতে এনে  সরকারি পশু ডাক্তার দেখাতে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। তা নাহলে তারা আসেনা। ভিজিট দেয়া লাগে, বাড়তি ঔষুধ কিনতে হয়।
আরেক খামারি খোকন বলেন, প্রানী সম্পদের জন্য ভোলা একটি অপার সম্ভাবনাময় জেলা। এই জেলায় প্রচুর গরু মহিষ পালন করা হয়। এই কথা চিন্তা করে পশুর সবচেয় বড় সমস্যা ক্ষুরা রোগের জন্য একটি প্রকল্প নিয়েছেন। অথচ এই প্রকল্পে কোন সুফল খামারিরা পাচ্ছেনা। আমরা দেখছি এই জেলার জন্য ক্ষুরারোগের যে ভ্যাকসিন আসছে তা বাইরের জেলায় নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। ফলে এই জেলার খামারিরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যারা এই ভ্যাকসিন নিয়ে বাইরে বিক্রি করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।
জেলা প্রানী সম্পদ কর্মকর্তা ইন্দ্রজিৎ কুমার মন্ডল বলছেন সরকারিভাবে পিপিআর ও ক্ষুরা রোগ নির্মূল প্রকল্পের ভ্যাকসিন যারা কালো বাজারিতে বিক্রি করেছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। আর ইতিমধ্যে সকল খামারিদের ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
জেলার ৭টি উপজেলার ৬৯ ইউনিয়নের ৬৯ জন কর্মী দিয়ে ‘পিপিআর রোগ নির্মূল ও ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণ’ নামের এই প্রকল্প চলমান আছে। এর মাধ্যমে গবাদি পশুকে অনাকাংখিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। এরমাধ্যমে জেলার ৩৪৫২ জন ছোট বড় খামারি এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য টিকা-ওষুধও এর সুবিধা পাওয়ার কথা রয়েছে।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ভোলা প্রাণীসম্পদ অফিসের সরকারি ভ্যাকসিন নোয়াখালীতে বিক্রির দায়ে এক ব্যাক্তিকে আটক করেছে পুলিশ। তাকে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার আট কপালিয়া বাজারের নুরজাহান এন্টার প্রাইজের সামনে রাস্তার উপর থেকে আটক করা হয়। তার নাম তারিকুর রহমান। সে ভোলা উপজেলার প্রাণীসম্পদ অফিসের বাপ্তা ইউনিয়নের ভলেন্টিয়ার ভ্যাকসিনেটর হিসাবে কর্মরত ছিলেন। গ্রেফতারের সময় তার নিকট থেকে ৫০ এম,এল এর ৩১টি এবং ৩০ এম,এল এর ২৭টি, মোট ৫৮ টি ভ্যাকসিনের ভায়াল জব্দ করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:১০:৪৫   ৪৬৫ বার পঠিত