মরহুম মোশারেফ হোসেন শাজাহন ॥ সোনালী স্মৃতির এক অধ্যায়

প্রচ্ছদ » প্রধান সংবাদ » মরহুম মোশারেফ হোসেন শাজাহন ॥ সোনালী স্মৃতির এক অধ্যায়
মঙ্গলবার, ৪ মে ২০২১



---

: মুহাম্মদ শওকাত হোসেন :

মোশারেফ হোসেন শাজাহান ভাইকে নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি। তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী না হয়েও সান্নিধ্য পেয়েছি ১৯৭৬ থেকে আমৃত্যু। ১৯৭৬ সালে আমি ভোলা কলেজের ছাত্র। সে বছর দুটি ঘটনার মধ্যদিয়ে আমি শাজাহান ভাই এর সংস্পর্ষে আসি। ঐ বছর ভোলায় বাংলা স্কুল মাঠে একটি ইসলামী সেমিনার হয়েছিল, যা নানা কারনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত সেমিনার কমিটির সভাপতি ছিলেন মোশারেফ হোসেন শাজাহান আর সেক্রেটারী ছিলেন প্রফেসর সামছুল আলম চৌধুরী। সেমিনারে বাংলাদেশের দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক (পরবর্তীতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি) ডঃ মোস্তাফিজুর রহমান ও রেডিও পাকিস্তানের ‘কোরআনে হাকিম ও আমাদের জেন্দেগী’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক তৎকালীন ‘কায়েদে আজম কলেজের অধ্যাপক মাওঃ হেলাল উদ্দিন সাহেব যোগ দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হলো এ আগমনের সুত্র ধরেই শাজাহান ভাই’র অনুজ সাবেক পৌর মেয়র বর্তমান বিএনপির নেতা আলহাজ্ব গোলাম নবী আলমগীরের সঙ্গেঁ প্রফেসর মাওঃ হেলাল উদ্দিনের কন্যা প্রফেসর মুশতারী বেগমের সঙ্গেঁ শুভ বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এ সেমিনার এবং এ বছর কবি মোজাম্মেল হকের ইন্তেকালে অনুষ্ঠিত শোকসভা ও স্মৃতি সংসদের সুবাধে শাজাহান ভাইয়ের সঙ্গেঁ আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সম্পর্কের সূচনা ঘটে। পরবর্তীতে তিনি আমাদের চিন্তা চেতনার অনেকট জুড়ে যায়গা করে নিয়ে ছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে তাকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখে আমরা এগিয়েছি।
তাঁর সঙ্গেঁ সংশ্লিষ্ট অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতি একটি আজ উল্লেখ করবো। ১৯৯২ সাল। শাজাহান ভাই তখন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী। কবি মোজাম্মেল হক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কবি পুত্র সাবেক সচিব তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (পরিকল্পনা) এম মোকাম্মেল হক। আমি ফাউন্ডেশনের সম্পাদক। আমরা ঠিক করলাম ভোলায় একটি সাহিত্য সম্মেলন করবো। এটা বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বর্তালো আমার উপরে। আমরা সেবার ভোলার দুই প্রধান রাজনৈতিক নক্ষত্র প্রতিমন্ত্রী মোশারেফ হোসেন শাজারহান এবং বিরোধী দলের এমপি তোফায়েল আহমেদকে ভোলা কবি মোজাম্মেল হক টাউন হলে একই মঞ্চে বসালাম। কবি সাহিত্যিকরা যারা ছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন বর্ষিয়ান জাতীয় অধ্যাপক অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (৯২ বছর বয়স), ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি আবদুল হাই সিকদার, ডঃ আবুল হাসান শামছুদ্দিন, মোস্তফা হারুন, কবি নাসির আহমেদ প্রমুখ। আমি অবশ্য ভোলার দুই রাজনৈতিক নক্ষত্রকে দুটি অধিবেশনে প্রধান অতিথি করেছিলাম। কিন্তু তোফায়েল আহমেদ সাহেবের লক্ষ বিলম্বে পৌছার কারনে দুটি অধিবেশন একবারে করতে হয়েছিলো। বক্তৃতায় কিছু রাজনৈতিক প্রসঙ্গঁ এসে যাওয়ার ফলে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। এতে শাজাহান ভাই সামান্য হলেও বিব্রত হন। অধিবেশন শেষে আমরা একই গাড়িতে সার্কিট হাউজ যাই। গাড়িতে উনি আমাকে এক চোট নিলেন। অর্থাৎ ‘স্পেপ গোট’ হলাম আমি। আমি প্রতিবাদ করতে চাইলে কবি আসাদ চৌধুরী আমাকে নিবৃত করে। এ ঘটনার পর আমি ৩ পাতার একটি চিঠি দিয়ে শাজাহান ভাই এর সঙ্গেঁ  সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করলাম। চিঠির শিরোনাম ছিল ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো…’ আমি ওনার সঙ্গেঁ সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেই। শাজাহান ভাই চিঠি পেয়ে মরহুম মোস্তফা কামালকে দিয়ে আমাকে দেখা করার জন্য খবর দিলেন। আমি গেলাম না। ভোলা সার্কিট হাউজে মরহুম ডাঃ আঃ মান্নানকে নিয়ে রুদ্ধদ্বারে অনেক বুঝালেন। তাতেও আমি গেলাম না। বিষয়টি মোকাম্মেল হক সাহেবের কানে গেলে তিনি বাসায় একদিন আমাকে এবং শাজাহান ভাইকে দাওয়াত দিলেন। যথারীতি আমরা গেলাম সেখানে অনেক কথা হলো শেষ পর্যন্ত আমরা আগের মতো স্বাভাবিক হলাম। মোকাম্মেল হক সাহেবের একটি অভ্যাস আছে, তিনি মেহমানসহ খাওয়ার টেবিলে খাওয়া শেষে বেশ কিছুক্ষন গল্প করেন। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হলো না। এক পর্যায়ে মোকাম্মেল হক সাহেব শাজাহান ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, শাজাহান ভোলার নদী ভাঙনের বিষয়ে তুমি কি ভাবছো। শাজাহান ভাই বললেন, আমি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার দিন থেকে একটা কিছু করার জন্য চেষ্টা করছি। এখনো মন্ত্রী মেজর জেনারেল মাজেদুল হককে ভেদ করে কিছু করতে পারিনি। তবে শীঘ্রই একটা কিছু করবো আশা করি। মোকাম্মেল হক সাহেব স্বভাবসূলভ ভঙ্গীতে বললেন, রাখোতো তোমার মেজর মাইনর দিয়েও অনেক বড় কাজ হয়ে যায়। এই বলে তিনি তখনি তৎকালীন পানি সম্পদ সচিব আসাফউদৌল্লাহ সাহেবকে ফোন করলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে মোকাম্মেল হক সাহেব ‘বন্ধু কেমন আছো’ বলে কথা শুরু করে দিলেন। কুশলদির পর তিনি বললেন বন্ধু তোমার ফরিদপুর শহর রক্ষা প্রকল্প প্লানিং এসে জমা হয়েছে। তবে তা পাশ হবে না। আসফউদৌল্লা কেন না জানতে চাইলে মোকাম্মেল সাহেব বললেন, তোমার মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী মহোদয় আমার ছোট ভাই তুল্য, তার এবং আমার বাড়ি ভোলায়। ভোলা মেঘনা নদীতে ভেঙ্গেঁ যাচ্ছে। অথচ ভোলা শহর রক্ষার কোন প্রকল্প নেই। তোমার শহর ফরিদপুর এখনো ভেঙ্গেঁ যাচ্ছে না অথচ সে প্রকল্প তুমি দিয়েছো। এখন যদি একই সঙ্গেঁ ভোলা শহর রক্ষা প্রকল্প প্লানিং এ আসে তাহলে দুটোই পাশ হবে। নইলে নয়। টেলিফোনেই সিদ্ধান্ত হলে দু’দিনের মধ্যে শাজাহান ভাই এর অফিসে বসে প্রকল্প তৈরী করে পরিকল্পনা কমিশনে। যথারীতি জমা দেয়া হবে। ঠিকই পরদিন শাজাহান ভাই এবং সচিব সাহেবের তত্ত্বাবধানে শাজাহান ভাই এর অফিস কক্ষে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও অন্যান্যরা দিনভর বসে প্রকল্প তৈরী করলেন। জমা হলো এবং যথারীতি পাশ হলো। টেলিফোন শেষ হলে শাজাহান ভাই মোকাম্মেল হক সাহেবকে বললেন ভাই আমার সারা জীবনের স্বপ্ন ভোলাকে নদী ভাঙন থেকে রক্ষায় বড় কিছু করা। আজ আপনি তা সহজ করে দিলেন। এরই ফলশ্রুতিতে কার্যকর হলো ভোলা শহর রক্ষা প্রকল্প। এ প্রকল্প’র মাধ্যমেই তুলাতুলী পর্যন্ত ব্লক বসানো হয়। যার ফলে ভোলা কঠিন ভাঙনের হাত থেকে তুলাতুলি পর্যন্ত রক্ষা পায়। পরে অবশ্য এ ভোলা রক্ষা প্রকল্প করে বোরহানউদ্দিন, দৌলতখান, লালমোহন, তজুমদ্দিন, চরফ্যাশন ও মনপুরায়ও ব্লক ফেলা হয়েছে। তবে ভোলা রক্ষায় এ ঐতিহাসিক গুরুত্ব কাজটির শুভ সূচনা করে গেছেন মোশারেফ হোসেন শাজাহান। তাঁর নেতৃত্বেই ভোলা শহর ভাঙনের হাত থেকে প্রথম রক্ষা পায়। একাজের নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছেন এম মোকাম্মেল হক। এ সব কিছুর একজন নীরব সাক্ষী ছিলাম আমি।
ভোলা তথা বাংলাদেশের মানুষের জীবন মান উন্নয়ন সহ মৌলিক সমস্যা সমূহ সমাধানের ক্ষেত্রে মোশারেফ হোসেন শাজাহানের এ ধরনের অনেক ভুমিকা রয়েছে। তাঁর সঙ্গেঁ ৩৮ বছরে সান্নিধ্যে এ ধরনের আরো বহু ঘটনা আজ মনে পরে। তিনি মানুষের কল্যান ও শান্তি সৌহার্দের জন্য জীবনভর কাজ করেছেন। আজ মৃত্যুর পরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সকল সৎ কাজকে কবুল করে তাকে চীর শান্তি নছিব করবেন মৃত্যু বার্ষিকীতে এটাই কামনা করছি।
##
লেখকঃ মুহাম্মদ শওকাত হোসেন
সম্পাদক ও প্রকাশক
দৈনিক আজকের ভোলা

বাংলাদেশ সময়: ২২:২৪:১৩   ৫৮৮ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

প্রধান সংবাদ’র আরও খবর


ভোলার বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না বেশীরভাগ পন্য
ভোলায় নিষেধাজ্ঞার ১৮ দিনে ১৫৬ জেলের কারাদণ্ড
ভোলায় উন্নয়ন সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
ভোলা সদর উপজেলা নির্বাচনে ভোটারদের দুয়ারে চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাম্মদ ইউনুছ
ভোলায় নানা আয়োজনে বঙ্গবন্ধুর ১০৪তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন
অবৈধ দখলে চলে যাচ্ছে পাউবো’র জমি ॥ নিরব কর্মকর্তারা
ভোলায় বঙ্গবন্ধু সাজে সেজেছে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা
বোরহানউদ্দিনে ৩ মাদকসেবীকে আটক ॥ টাকার বিনিময়ে ২জনকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ
ভোলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে গমের আবাদ
কাউন্সিলর থেকে উদ্যোক্তা লালমোহনের মনির



আর্কাইভ